বুধবার, ৩০শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ,১৫ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

১৩ উপজেলায় পানিবন্দি লক্ষাধিক মানুষ

লালমনিরহাট প্রতিনিধি: ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের তিস্তা এবং দুধকুমার নদের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

এতে দুই নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ, তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ আমন ধান ও সবজির খেত, ডুবে গেছে রাস্তাঘাটও।

গবাদিপশু ও আসবাবপত্র নিয়ে অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন সরকারি রাস্তা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধের ওপর। কেউ কেউ পলিথিন মোড়ানো ঝুপড়ি তৈরি করে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় হাতীবান্ধা উপজেলার তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে তিস্তার পানি ৫২ দশমিক ৩০ মিটার রেকর্ড করা হয়, যা বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপরে। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার পাটেশ্বরী পয়েন্টে দুধকুমারের পানি রেকর্ড করা হয় ২৯ দশমিক ৬৬ মিটার, যা বিপদসীমার ৬ সেন্টিমিটার ওপরে।

ব্রহ্মপুত্র, ধরলাসহ অন্যান্য নদীর পানি বাড়লেও তা এখনো বিপদসীমার নিচে রয়েছে। কুড়িগ্রামের চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্রের পানি রেকর্ড করা হয়েছে ২২ দশমিক ৩৪ মিটার, যা বিপৎসীমার ৯১ সেন্টিমিটার নিচে এবং কুড়িগ্রাম সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি রেকর্ড করা হয়েছে ২৫ দশমিক ৪৫ মিটার, যা বিপৎসীমার ৬০ সেন্টিমিটার নিচে রয়েছে।

পানি বিপদসীমা অতিক্রম করায় লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর, গাইবান্ধা ও নীলফামারী জেলার তিস্তাপাড়ের ১৩ উপজেলার ৩৩টি ইউনিয়ন এবং কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার দুধকুমারপাড়ের ৮ ইউনিয়নের ২২০টি চর ও নদী তীরবর্তী গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডালিয়া ডিভিশন তথ্যকেন্দ্র জানিয়েছে, আজ সকাল ৯টায় ডালিয়া ব্যারেজ পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

চলমান বন্যা পরিস্থিতিতে তিস্তা অববাহিকার ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলো হলো, চর খড়িবাড়ী, পূর্ব খড়ীবাড়ী, একতার চর, সতীঘাট, ঝাড়সিংহেস্বর, ছোটখাতা, টেপা খড়িবাড়ী, খগাখড়িবাড়ী, গয়াবাড়ী, খালিশা চাপানী, ভেন্ডাবাড়ী, ঝুনাগাছ চাপানী, ছাতুনামা, পাগলপাড়া, গোলমুন্ডা, ডাউয়াবাড়ী, শোলমারী ও কইমারী ইত্যাদি।

ডিমলা উপজেলার খগাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম জানান, তার এলাকায় পাগলপাড়া গ্রামের পাশের চর থেকে গত ২৪ ঘণ্টায় ৮০টি পরিবার সহায় সম্বল হারিয়ে অন্যত্র চলে গেছে। এসব পরিবারের প্রায় চার শতাধিক মানুষ চরমভাবে খাদ্য ও সুপেয় পানি সংকটে ভুগছে।

একই উপজেলার পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান জানান, তার এলাকার ঝাড়সিংহেস্বর চরের ১ হাজার ৫০০টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ সংখ্যা বাড়ছে।

পাউবোর ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী জানান, ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এবং বিশাল এলাকার শস্যখেত ও বাড়িঘর নিমজ্জিত হয়েছে।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শুনীল কুমার বলেন, ‘তিস্তার বুকে চর ও তীরবর্তী এলাকা প্লাবিত হয়েছে। উজানের ঢল অব্যাহত থাকায় পানি কমার সম্ভাবনা কম। তিস্তা ব্যারেজের সব গেট খুলে দেওয়া হয়েছে, ফলে ভাটিতেও পানি বাড়ছে।’

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান জানান, ‘দুধকুমারের পানি বিপৎসীমার ওপরে। উজানের ঢলে পানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। ব্রহ্মপুত্র প্লাবিত হলে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। কেননা এ অঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমারসহ সব নদ-নদীর পানি পতিত হয় ব্রহ্মপুত্রে।’

কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘তিস্তা ও দুধকুমারপাড়ের বিপুল পরিমাণ আমন ধান ও সবজিখেত পানিতে তলিয়ে গেছে, তবে পরিমাণ এখনো নির্ণয় করা হয়নি। ২-৩ দিনের মধ্যে পানি না নামলে সবজির ব্যাপক ক্ষতি হবে, তবে আমনের তেমন ক্ষতি হবে না।’

লালমনিরহাট সদর উপজেলার কালমাটি এলাকার কৃষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ঘরের ভেতর কোমর সমান পানি। গবাদিপশু নিয়ে রাস্তার ওপর আশ্রয় নিয়েছি। বুধবার রাত থেকে পলিথিনে মোড়ানো ঝুপড়িতে থাকছি। রান্না করতে না পারায় খাবারের কষ্টে আছি।’

তিনি জানান, তার ৬ বিঘা জমির আমন ধান ও দুই বিঘা জমির সবজিখেত এখন পানিতে নিমজ্জিত। পানি দ্রুত না নামলে সবজিখেত মারারত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

নাগেশ্বরী উপজেলার চর নারায়ণপুরের কৃষক দেলোয়ার শেখ বলেন, ‘ভোরে হঠাৎ পানি বেড়ে ঘরে ঢুকে পড়ে। আমরা দিশেহারা হয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাই। একটি ছাগল ও কয়েকটি মুরগি বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। রান্না করতে না পারায় শুকনো খাবার খেয়ে বেঁচে আছি।’

নাগেশ্বরী উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম জানান, ইউনিয়নের ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে ৮ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে মানুষকে নৌকায় করে নিরাপদ স্থানে নেওয়া হচ্ছে এবং তাদের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ চলছে।

হাতীবান্ধা উপজেলার ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মশিউর রহমান বলেন, ‘তিস্তার দুর্গম চরাঞ্চলের অনেকেই গবাদিপশু ও আসবাব হারিয়েছেন। তারা উঁচু স্থানে পলিথিনের ঝুপড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।’

তিনি জানান, তার ইউনিয়নে দশ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। সরকারি ও বেসরকারিভাবে পানিবন্দি মানুষের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।

লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, ‘পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুদ রয়েছে। পানিবন্দি মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ চলমান রয়েছে। তিস্তাপাড়ের বন্যা পরিস্থিতি মনিটরিং করা হচ্ছে।’

কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক নূসরাত সুলতানা জানান, বন্যাদুর্গত এলাকায় কন্ট্রোলরুম চালু করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। পানিবন্দি মানুষের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Tumblr
Telegram

, বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

যায়যায়কাল এর সর্বশেষ সংবাদ