নিউজ ডেস্ক: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জাতির পিতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পেশাগত দক্ষতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার মাধ্যমে আন্তরিকভাবে দেশের সেবা করবে।
তিনি বলেন, ‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস সেনাবাহিনীর সকল সদস্য মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাতির পিতার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থা ও পরিপূর্ণ অনুগত থেকে কঠোর অনুশীলন, পেশাগত দক্ষতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার সমন্বয়ে নিষ্ঠার সাথে দেশের সেবায় কাজ করে যাবেন।’
প্রধানমন্ত্রী আজ সকালে সাভার সেনানিবাসে সিএমপি সেন্টার এন্ড স্কুলে সদর দপ্তর ৭১ মেকানাইজড ব্রিগেড, ১৫ ও ৪০ ইষ্ট বেঙ্গল (মেকানাইজড) এবং ৯ ও ১১ বীর (মেকানাইজড) এর পতাকা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন। তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে যুক্ত হন।
প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষাসহ জাতীয় যে কোন প্রয়োজনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে সদা প্রস্তুত থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সেনাবাহিনী দেশের যে কোন দুর্যোগ মোকাবেলায় জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি সিলেট, সুনামগঞ্জ এবং নেত্রকোণা জেলায় আকসি¥ক ভয়াবহ বন্যায় প্রশংসনীয় ভূমিকার পালনের জন্য আমি সেনাপ্রধানসহ এই বাহিনীর সকল সদস্যকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, ‘অপারেশন কোভিড শিল্ড’ এর মাধ্যমে সেনাবাহিনীর সদস্যরা করোনা প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় এবং বিভিন্ন বৈদেশিক মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের আত্মত্যাগ, কর্তব্যনিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছে সম্মান ও মর্যাদা, যা বহিঃর্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে অত্যন্ত উজ্জ¦ল করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আবহমান কাল থেকেই যুদ্ধের ময়দানে জাতীয় মর্যাদার প্রতীক ‘পতাকা’ বহন করার রীতি প্রচলিত আছে। পতাকা হল জাতির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, সম্মান এবং মর্যাদার প্রতীক। তাই পতাকার মান রক্ষা করা সকল সৈনিকের পবিত্র দায়িত্ব।
অনুষ্ঠান থেকে প্রধানমন্ত্রীকে মনোজ্ঞ কুচকাওয়াজের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সালাম জানানো হয়। সেনাপ্রধান জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আমরা সরকার গঠন করি। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরি। সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করি। ১৯৯৮ সালে ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ’ এবং ‘মিলিটারি ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজি’, ১৯৯৯ সালে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন ট্রেনিং’ এবং ‘আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করি।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে পুনরায় সরকার গঠনের পর প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন যুগোপযোগী সামরিক বাহিনী গঠনের লক্ষ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করছি। আমরা ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর আধুনিকায়ন, সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন করছি।
শেখ হাসিনা বলেন, ২০১৬ সালে ‘বাংলাদেশ পিস বিল্ডিং সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা এবং জাতির পিতা প্রণীত প্রতিরক্ষানীতিকে যুগোপযোগী করে ‘জাতীয় প্রতিরক্ষানীতি, ২০১৮’ প্রণয়ন করেছি। এছাড়া এ্যারোস্পেস ও এভিয়েশন বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং সিএমএইচগুলোকে অত্যাধুনিক হাসপাতালে রূপান্তরিত করেছি।
দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করতে সিলেটে ১৭ পদাতিক ডিভিশন, রামুতে ১০ পদাতিক ডিভিশন এবং বরিশালে ৭ পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠা করেছে সরকার। তিনি বলেন, গত ৪ বছরে বিভিন্ন ফরমেশনের অধীনে ৩টি ব্রিগেড এবং ছোট বড় ৫৮টি ইউনিট প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সম্প্রতি মাওয়া-জাজিরাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শেখ রাসেল সেনানিবাস এবং মিঠামইন, রাজবাড়ী ও ত্রিশালে নতুন সেনানিবাস স্থাপনের কার্যক্রম চলছে।
সরকার প্রধান বলেন, আমরা সেনাবাহিনীতে নতুন কম্পোজিট ব্রিগেড ও প্যারা কমান্ডো ব্রিগেড যুক্ত করেছি। তাছাড়াও অত্যাধুনিক এম.বি.টি.-২০০০ ট্যাংক, অ্যাম্ফিবিয়াস ট্যাংক ভিটি-৫, এম.এল.আর.এস রেজিমেন্ট, মর্টার রেজিমেন্ট, সেল্ফ প্রোপেল্ড রেজিমেন্ট, এম.আই.-১৭১ এস.এইচ. হেলিকপ্টার ও কাসা সি-২৯৫ ডব্লিউ এর মত অত্যাধুনিক পরিবহন বিমান, অত্যাধুনিক ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র মেটিস-এম-১, বিমান বিধ্বংসী মিসাইল এফ.এম.-৯০ এবং আধুনিক পদাতিক সৈনিক ব্যবস্থা সেনাবাহিনীতে যুক্ত করেছি।
সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নের পাশাপাশি ’৭৫ এ জাতির পিতাকে হত্যার পর দেশে একের পর এক সেনাশাসন, হত্যা ক্যু এবং ষড়যন্ত্রের রাজনীতির অতীত ইতিহাসও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্য্যা করার পর বাংলাদেশের বিজয়ের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস মুছে যায়। একের পর এক সেনাবাহিনীতে ক্যু হতে থাকে। সামরিক বাহিনীর অফিসার সৈনিকদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। লাশ গুম করে দেয়া হয়।’
তিনি বলেন, এখনও সেদিন গুম হওয়াদের স্বজনহারারা কেঁদে বেড়াচ্ছে সেই বেদনা নিয়ে। ইনডেমনিটি অর্ডিনেন্স জারি করে জাতির পিতার হত্যার বিচারের পথ বন্ধ করে খুনীদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরী দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়।
’৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হলে সে সময়কার সেনাশাসকের রক্তচক্তু উপেক্ষা করে এক রকম জোর করেই প্রবাস জীবন কাটানোয় বাধ্য হওয়া অবস্থা থেকে শেখ হাসিনা দেশে ফেরেন এবং সেনাবাহিনীর এই সদস্যদের হত্যার প্রতিবাদ করেন বলে জানান তিনি।
তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সশস্ত্র বাহিনীতে আর কোন ছেলেহারা মায়ের ও স্বজনহারা পিতার কান্না এবং সন্তানের আহাজারি শুনতে চাইনা। আর কোন বিধবা দেখতে চাইনা।’
সরকারের আসার পর দেশের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকায় দেশের আর্থসামাজিক এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের উল্লেখযোগ্য চিত্রও তুলে ধরেন তিনি।
তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পেক্ষাপটে বৈশি^ক মন্দার কথা উল্লেখ করে দেশের প্রতি ইঞ্চি জমিকে চাষাবাদের আওতায় আনার মাধ্যমে সার্বিক উৎপাদন বাড়ানোর আহবান অনুষ্ঠানে পুণর্ব্যক্ত করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের নিমিত্তে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পদাতিক ব্রিগেড ও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পদাতিক ব্যাটালিয়নকে মেকানাইজড হিসেবে রূপান্তরিত করা হয়েছে। আজ তাদের বহু প্রতীক্ষিত পতাকা উত্তোলন করা হলো। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মেকানাইজড ইউনিট সংযোজনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিবাদন জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, আমি আশা করি, জাতীয় নিরাপত্তা ও ঝুঁঁকি মোকাবেলায় এই মেকানাইজড ইউনিটসমূহের সংযোজন এক নতুন মাত্রা যোগ করবে ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ একটি সুশৃঙ্খল ও মনোজ্ঞ কুচকাওয়াজ উপহার দেয়ার জন্য আমি আপনাদেরকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। এ মনোজ্ঞ কুচকাওয়াজ এবং সুন্দর ব্যবস্থাপনায় যাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তাঁদের সকলের জন্য রইল আমার আন্তরিক ধন্যবাদ।
এছাড়াও আজকের এই অনুষ্ঠান সুন্দরভাবে আয়োজন করায় তিনি সেনাবাহিনী প্রধানসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।