বৃহস্পতিবার, ২৭শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ,১২ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

এর সর্বশেষ সংবাদ

নষ্ট রাজনীতির দুষ্ট চক্র : ডা. মোঃ সাইফুল ইসলাম

ডা. মো. সাইফুল ইসলাম: স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে অসুস্থ রাজনীতি চলছে। রাজনীতিতে ধরেছে পচন ক্রিয়া। পচন ক্রিয়াটি আস্তে আস্তে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পৌছেছে। অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ যুক্তি, হিংসা আর প্রতিহিংসার নষ্ট রাজনীতির দুষ্ট চক্র গোটা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট গ্রাস করে ফেলেছে। আর সে কারণে সবকটি সরকারই তাদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। ফলে কোনকিছুই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে নাই, না নিজ দলের উপর, না বিরোধী দলের উপর। না প্রশাসনের উপর, না জনগণের উপর, সন্ত্রাসীদের কথা না বলায় ভাল। অন্যায়, অনিয়ম, নিয়মনীতির অপব্যবহার, দুর্নীতি সন্ত্রাস, খুন হু হু করে বেড়েই চলেছে। নষ্ট রাজনীতির দুষ্ট চক্র সবকটি সরকারকে গিলে ফেলেছে। ফলে রাষ্ট্রের সবগুলো বিভাগে চলছে প্রতিযোগিতামূলক দুর্নীতি। অফিস আদালত, সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা তথা যে দিকে তাকাই সেদিকেই অন্যায় অনিয়ম ও নিয়ম নীতির অপব্যবহার ছাড়া আর কিছুই নেই। নিয়োগ পদোন্নতি বদলি ও জনকল্যাণমূলক কাজ সবকিছুই চলছে উৎকোচের বদৌলতে। ফলে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অর্থাৎ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জনগণ। অর্ধহারে অনাহারে বস্ত্রাভাবে, শীতের যন্ত্রণায় রাস্তায় ফুটপাতে লাখ লাখ মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে। স্বাস্থ্য সেবা থেকে নিরীহ, গরিব ও খেটে খাওয়া মানুষগুলো একেবারেই বঞ্চিত। ইউনিয়ন থেকে উপজেলা জেলা ও মেডিকেল কলেজগুলোতে স্বাস্থ্য সেবার মান একেবারেই করুণ ও বেদনাদায়ক। হাসপাতাল ও ডাক্তারদের উপর সাধারণ মানুষের বিশ্বাস একেবারেই নেই বললেই চলে। হাসপাতাল ও ডাক্তারদের কথা শুনলেই মানুষ আঁতকে উঠে। মনে হয় রোগী হাসপাতালে যাচ্ছে না। যাচ্ছে কারাগারে। কারাগারকেও আজকাল মানুষ কিছুটা নিরাপদ স্থান মনে করে। কিন্তু হাসপাতালগুলোতে তার চেয়ে যন্ত্রনাদায়ক কষ্ঠদায়ক ও নিরাপত্তাহীন স্থান বলে মানুষ ঘৃণার চোখে দেখছে। আজকাল যেমন প্রায় সবগুলো মটরযানের গায়ে সুন্দরভাবে বিরতিহীন, গেটলক, লেখা চোখে পড়ে কিন্তু বাস্তবে একটিও বিরতিহীন, গেটলক নয়, ঠিক তেমনি অবস্থায় স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো বিরাজ করছে।

শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা ছাড়া দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা মোটেই সম্ভব নয়। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থার যা অবস্থা তাতে জাতির মেরুদন্ড আছে কি? না দিন দিন মেরুদন্ডহীন হয়ে যাচ্ছে? মেরুদন্ডহীন প্রাণী যেমন সোজা হয়ে দাড়াতে পারে না, ঠিক তেমনি জ্ঞানহীন ও মেধাশুন্য জাতি এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে প্রতিযোগিতামূলক আধুনিক বিশ্বে মেরুদন্ড সোজা করে টিকে থাকতে পারে না। বর্তমানে আন্তর্জাতিক ডিগ্রি অর্থাৎ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার সুযোগ হাতের নাগালে অর্থাৎ আমাদের দ্বারপ্রান্তে। অথচ শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থার বাস্তব অবস্থা এতোই করুণ ও হৃদয়বিদারক যা ভাষায় প্রকাশ করতে কষ্ট হয়। দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের প্রেতাত্মা আমাদের চারপাশ যেন গ্রাস করে ফেলেছে। চারপাশ বললে ভুল হবে। আমাদের অঙ্গ প্রতঙ্গ থেকে শুরু করে শিরা উপশিরা ও রক্তে ঢুকে পড়েছে। ফলে মানবতা মানবিক মূল্যবোধ ও বিদ্যা, মেধা ও স্মৃতি শক্তি সবকিছুই আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। সমগ্র দেশের এই পরিবেশ পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের স্মৃতি শক্তির ধারণক্ষমতা অচল হয়ে পড়েছে।

পরীক্ষা হলো শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাই এর এক বিশেষ প্রক্রিয়া। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কেবল শিক্ষার্থীর জীবনের লব্ধ জ্ঞানের পরিধি পরিমাপ করা যায়। আর এজন্য পরীক্ষাকে মানব জীবনের কষ্টি পাথর বলা হয়। অতীব দুঃখের বিষয় কষ্টি পাথর তাও নানা দুর্নীতির চরম শিকারে পরিণত হয়েছে। পরীক্ষা প্রথাটা এখন সার্টিফিকেট সর্বস্ব হয়ে পড়েছে। সার্টিফিকেট সর্বস্ব শিক্ষা জাতির জন্য কলঙ্কস্বরুপ। শিক্ষা ক্ষেত্রের এই শোচনীয় অবস্থা দেখে গোটা জাতি আজ উদ্বিগ্ন ও হতাশাগ্রস্থ। নষ্ট রাজনীতি ও দুষ্টচক্র শিক্ষাক্ষেত্র ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ঠেলে দিয়েছে বললে ভুল হবে, ধ্বংস করেই ফেলেছে। ফলে শিক্ষাঙ্গনে চলছে দুর্বৃত্তায়ন। দুর্বৃত্তায়নের কারণে শিক্ষাক্ষেত্র পরিণত হয়েছে রণক্ষেত্র। রণক্ষেত্রে প্রতিদিন দুর্বৃত্তায়নের মহড়া চলছে। আর এই মহড়ায় শিক্ষার পরিবর্তে সোনার ছেলেরা লাশ হয়ে
ঘরে ফিরছে। স্কুল, কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা মেধা ও জ্ঞানের প্রতিযোগিতার পরিবর্তে চলছে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের প্রতিযোগিতা। যারা দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের প্রতিযোগিতায় টিকে যাচ্ছে তারাই সফলতা লাভ করছে। যারা টিকে থাকতে পারছে না তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসছে। এই তো শিক্ষা ক্ষেত্রের বাস্তব অবস্থা। শিক্ষা ব্যবস্থার বাস্তব চিত্র যদি এই হয় তাহলে কিভাবে শিক্ষার সুস্থ পরিবেশ আশা করা যায়। অদক্ষতা অব্যবস্থাপনা, অন্যায়, অসত্য, নিয়মনীতির অপব্যবহার দেশের সবকিছুই গ্রাস করে ফেলেছে। ফলে বেকারত্বের সংখ্যা দিন দিন সীমাহীনভাবে বেড়েই চলেছে। হাজার হাজার শিক্ষিত ও অশিক্ষিত বেকার যুবক যুবতি অভিশপ্ত জীবন যাপন করছে। যে জীবন একজন সভ্য সুস্থ্য মানুষের পক্ষে কত কষ্টদায়ক, বেদনাদায়ক ও যন্ত্রনাদায়ক তা ভাষায় প্রকাশ করা খুবই কঠিন। বেকারত্ব দেশ ও জাতির জন্য এক চরম অভিশাপ। বর্তমানে বেকারত্ব দেশের স্বয়ংসম্পূর্ণ, অগ্রগতি ও উন্নয়নের পথে বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করতে না পারলে অদুর ভবিষ্যতে আমাদের ভাগ্যে অপেক্ষা করছে এক নরক যন্ত্রণা। এই নরকের আগুনে সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। মান সম্মান, ইজ্জত ও সম্ভ্রম নিয়ে কেউ সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করতে পারবে না। সেদিন আর বেশি দুরে নেই। দুষ্ট চক্রের কালো ছায়া ধূম্রজালের মতো কুন্ডলীকায় ঘণিভুত হচ্ছে। অমঙ্গল, অসুন্দর ও কুৎসিত আমাদের চারদিক ঘিরে ফেলেছে। আর এই অভিশপ্ত নরক থেকে বের হয়ে আসা খুবই কষ্ট সাধ্যের ব্যাপার। তা হলে উপায়? উপায় অবশ্যই আছে। মানুষ মরণশীল ও পৃথিবী ক্ষণস্থায়ী। এ মহাসত্য জানা সত্বেও মানুষ প্রতিনিয়ত প্রতিকুল অবস্থার সঙ্গে বাচার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। ঠিক তেমনি আমাদেরকে মুক্ত আকাশের নিচে নির্মল বাতাসে মুক্তভাবে বাঁচার জন্য লড়াই করে যেতে হবে। আমরা বাঙ্গালী জাতি। আমাদের ভাগ্যে কোনকিছুই সহজে আসেনি।

আমরা রক্ত সাগরে সাতার কেটে মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি। মাতৃভাষার সিঁড়ি বেয়েই অর্জন করেছি স্বাধীনতা। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা খুবই কঠিন। আমরা গণতন্ত্রের প্রক্রিয়াধীন চলছি। কিন্তু গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিতে পারিনি। আমরা সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিক শাসকদেরকে তাড়িয়েছি কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে পারিনি। আর একারণেই নৈতিক চরিত্র থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বাস্তবমুখি, সময়োপযোগি ও বিজ্ঞানসম্মত করে গড়ে তুলতে পারিনি। ফলে পাহাড় সমান ব্যর্থতা দুর্বিসহ জ্বালা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি। তবে একথাও সত্য, জীবন ফুল শয্যা নয়। পথ কুশুমাস্তীর্ণ নয়, চলার পথে কাঁটা থাকে, পিচ্ছিল কাদা থাকে, নদীনালা, খালবিল থাকে, নিটোল, নিখাঁত, নিখুত সুখ শান্তি একেবারেই লাগাতার জীবন অসম্ভব ও অস্বাভাবিক। জীবন দুঃখ সুখের দোল দোলানো বিচিত্র চেতনার সমষ্টি যা অনুরাগে বিরাগে, আসক্তিতে ও বিরক্তিতে জড়ানো, মেঘ ও রোদের খেলা যেমন। তাই আমরা জীবনের অবসান আশঙ্কায় নিত্য ভিত। মৃত্যু নয়, আয়ুই কাম্য, এমন কি অসুস্থ রুগ্ন অবস্থায়। তাই যদি হয় তাহলে আমাদের নৈতিক চরিত্র থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবক্ষয় থেকে কিভাবে মুক্তি পাওয়া যাবে তা আমাদেরকেই খুজে বের করতে হবে এবং বাস্তবায়নের জন্য দুর্বার গণ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আন্দোলন, সংগ্রাম ও রক্তছাড়া এদেশে কোন কিছুই প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। যার বাস্তব প্রমাণ ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রাম। মহান একুশের চেতনায় দেশ মাতৃকাকে রক্ষার অঙ্গিকারে বলিয়ান হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে যেভাবে এদেশের অকুতোভয় বীর সন্তানের রক্তক্ষরণ ও আত্মাদানের মাধ্যমে বর্বর হানাদার বাহিনীর মনোবল গুড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল বলেই সুশিক্ষিত যোদ্ধার শ্রেষ্ঠত্ব ১৬ ডিসেম্বর চিরতরে রমনার রেসকোর্স ময়দানে কবরস্থ করা সম্ভব হয়েছিল। সম্ভব হয়েছিল বাঙ্গালী জাতির হাজার হাজার বছরের চরম চাওয়া শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা। সেদিনের সেই মৃত্যু ছিল বীরের মৃত্যু। এমৃত্যু জীবন ভিক্ষা বা অতর্কিত গুলি লেগে লুটিয়ে পড়া নয়। স্থিরচিত্তে কাপুরুষতা পায়ে ঠেলে আদর্শের ঝান্ডা সমুন্নত রেখে মৃত্যুকে নির্ভীক আলিঙ্গন। এ মৃত্যু তাই অন্যান্য অম্লান। স্বাধীনতার ইতিহাস কোন কল্পকাহিনী নয়। আবেগে আক্রান্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীর প্রশংসার গল্প নয়। এ ইতিহাস বাস্তব সত্য পানির মতো স্বচ্ছ ঘটনা প্রবাহ। অনেকে আবার আমাদের স্বাধীনতা সল্পস্থায়ী যুদ্ধ বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দিতে চায়। এ ধরনের ভাবা বা চিন্তা চেতনা নিছক উদ্দেশ্যমূলক ও হীন মানসিকতা পরিচয় বহন করে। কারণ বাঙ্গালী জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা, মূলতঃ একদীর্ঘ পথ পরিক্রমা অতিক্রম করে পূর্ণতা ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের সময়কাল ছিল স্বল্পস্থায়ী। তবে একথাও সত্য যে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের চেয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছিল প্রচুর। এছাড়াও মুক্তিবাহিনীতে যারা যোগ দিয়েছিলেন তারা অবস্থার প্রেক্ষিতে বাধ্য হয়ে নয় বরং স্বেচ্ছায় আদর্শ ও দেশপ্রেমে বলীয়ান হয়ে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার তোয়াক্কা না করে যোগ দিয়েছিলেন। এটি চির সত্য বটে। তাই স্বাধীনতার যুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ হওয়া উচিৎ বাঙ্গালী জাতির চলার পথে পাথেয়, অনুপ্রেরণার উৎস ও সম্ভাবনাময় উজ্জল ভবিষ্যৎ গড়ার ভিত্তি প্রস্তর। কিন্তু আমরা ভুলে গিয়েছি একুশ, ভুলে গিয়েছি স্বাধীনতা যুদ্ধের বাস্তব দৃশ্য ও প্রেক্ষাপট। আজকে আমাদের অতীব জরুরি স্বাধীনতা যুদ্ধের মূলমন্ত্রে দিক্ষায়িত হয়ে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দেওয়ার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার চিরকবর রচনা করা।

স্বাধীনতার পর থেকে দলীয়করণ আস্তে আস্তে শহর থেকে নগর, নগর থেকে বন্দর, বন্দর থেকে গ্রামে গঞ্জে-গঞ্জে, রন্ধ্রে- রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। দলীয়করণের মরণ ছোবল ও অনিয়মতান্ত্রিক অশুভ প্রক্রিয়া থেকে জনগণ মুক্তি চায়।

গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করা রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার ।এ অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে যদি নির্বাচনত্তোর ও নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার স্বীকার হতে হয়। হতে হয় নির্যাতিত ও হত্যা, খুন ও ধর্ষনের স্বীকার। তা হলে চিরাচরিত এই পচা দুর্গন্ধ ও নষ্ট রাজনীতির প্রতি বা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রতি জনগনের বিশ্বাস থাকতে পারে কি?

স্বাধীনতার পর থেকে এদেশে ভেলকীবাজির রাজনীতি চলছে। চলছে প্রতারণা, প্রহসন ও বুলি সর্বস্ব রাজনীতি। অসত্য, অন্যায়, হিংসা আর প্রতিহিংসার রাজনীতি। এ ধরণের রাজনীতি অসৎ, অযোগ্য, অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, কালো টাকার, পেশি শক্তির মালিক, দেশাত্ববোধহীন ও মেধাশুন্য রাজনীতিবিদেরই জন্ম দিচ্ছে। এ ধরনের রাজনীতিবিদ দ্বারাস্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করা আশা করা আর অরণ্যে রোদন একই কথা নয় কি? জাতি এই অন্তসার শুন্য পচা দুর্গন্ধ ও নষ্ট রাজনীতির অবসান চায়। চায় সময়োপযোগি, বাস্তব, উন্নয়নমুখী, উৎপাদনমুখী রাজনীতি। চায় মননশীল, সৃজনশীল ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।
স্বাধীনতার পর রাজনীতির কাছে এদশের জনগণের প্রত্যাশা কি ছিল? বিগত চার দশকে জনগণের প্রাপ্তির হিসাবটি কেমন? জনগণের সেই প্রত্যাশা কালের গর্ভে হতাশার চোরাবালীতে হারিয়ে যায়নি কি?

বর্তমানে জ্ঞান প্রযুক্তির কল্যাণে ও উৎকর্ষিত আধুনিক মানব সমাজের কাছে পৃথিবী ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। কম্পিউটার ইন্টারনেট আর স্যাটেলাইটের অবাধ সৃজনী শক্তির দ্বারা অপরিমেয় ক্ষমতায় অধিকারী মানুষ পৃথিবীকে এনেছে হাতের মুঠোয়। জয় করে চলেছে আকাশ, পাতাল, চন্দ্র, সূর্য ও উপগ্রহ সমূহ। অগ্রগতির প্রতিষ্ঠায় জয়ী দেশগুলোর তাই অপরাপর, দেশের উপর কথা মানব সমাজের উপর প্রতিষ্ঠা করেছে তাদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও কুটনৈতিক কর্তৃত্ব। আমাদের মাতৃভুমি স্বাধীন বাংলাদেশেও এই আধুনিক পৃথিবীর পরিবার ভুক্ত সদস্য হওয়া সত্বেও রাজনীতিতে দুর্নীতিগ্রস্ত ও অদক্ষ প্রশাসন, অসাধু ব্যবসায়ী, আমলা এবং মজুতদারদের কারণে জাতি সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি আমরা পরিচিত হচ্ছি অসহায়, দারিদ্র পীড়িত, কর্মবিমুখ ও জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে যেন এক অন্ধকার জগতের ঘুমন্ত বাসিন্দা হিসেবে। উন্নত বিশ্ব যখন গ্রহ উপগ্রহে চালাচ্ছে নানা রকম পরীক্ষা তখন পর্যন্ত আমরা আমাদের ছোট দেশের অনেক মৌলিক সমস্যাকে কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এখনো আমরা লড়াই করে যাচ্ছি আমাদের নিত্য সহচর ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে। হাজারও সমস্যার ভিড়ে আমরা হারিয়ে ফেলেছি আমাদের সামর্থকে, নষ্ট করে ফেলেছি আমাদের সৃজনীশক্তিকে। ব্যর্থ হচ্ছি আমাদের সম্পদের সুষ্ট ব্যবহারের মাধ্যমে জাতির উন্নয়নের বিপুল সম্ভাবনা ও সুযোগকে যথাযথ ভাবে কাজে লাগাতে।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষিই আমাদের জীবিকা নির্বাহের পথ। কৃষকেরা ঝড় বৃষ্টি রৌদ্রকে উপেক্ষা করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দু’মুঠো ভাত, নূন্যতম কাপড় ও বাসস্থানের জন্য মাটির সাথে লড়াই করে যাচ্ছে। কিন্তু কৃষকেরা কি তাদের উৎপাদিত দ্রব্যের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে? অব্যবস্থাপনা, অসৎ অদক্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তা, অসাধুমজুতদার ও ব্যবসায়ীগণ কৃষকের উৎপাদিত দ্রব্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত করে আসছে। ফলে কৃষকেরা প্রতিবছর লোকসানের বিরাট বোঝা মাথায় নিয়ে রিক্ত, নিঃস্ব ও পথে বসতে শুরু করেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা খরা ঘূণিঝড় ইত্যাদি কৃষকের ভাগ্যের উপর প্রতিবছর নির্মিষের মধ্যে সর্বশান্ত হয়ে শোকে দুঃখে রোগে কংকালসার হয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় জীবন যাপন করছে। এছাড়া রাসায়নিক সার ডিজেল, মবিল দ্রবাদির মূল্য কৃষকের ক্রয় ক্ষমাতার বাইরে যাওয়ায় কৃষিক্ষেত্র ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলেছে। এমতাবস্থায় চলতে থাকলে বাঙ্গালী জাতির অধঃপতন নিশ্চিত।

বাংলাদেশে শতকরা ৮০ জন কৃষিজীবী। অথচ কোন সরকারই বিজ্ঞানসম্মত, বাস্তবমুখী ও উন্নয়নমুখি পদক্ষেপ নিতে পারেনি। কৃষিই যে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ, যার সাথে গোটা জাতির ভাগ্য জড়িত। সেই ভাগ্যের প্রতি নেই আমাদের নুন্যতম শ্রদ্ধাবোধ। কৃষকের ঘরেই আমাদের জন্ম, অথচ এই ঘর ও কৃষকের সাথে নেই আমাদের নিবিড় সম্পর্ক। অর্থাৎ কৃষকেরা আজ ঘৃণিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত ও নিগৃহীত হচ্ছে পদে পদে। ফলে কৃষকের জীবন যাত্রার মান নিম্নসীমার নিচে অবস্থান করছে। তাই কৃষকেরা অস্থিকংকালসার শরীর, উদ্যমহীন দেহ ও আশাহীন দুরাশার স্বপ্নে, নিরাশার ভেলায় অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাড়িয়ে সর্বনাশা ক্ষুধা, দারিদ্র দুঃখ কষ্ট, দুর্বিসহ জ্বালা নিয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় চলতে থাকলে অল্পের মধ্যেই জাতি তলিয়ে যাবে এক অন্ধারাচ্ছন্ন অন্তঃপুরে। এই অন্তঃপুর থেকে যদি বেরিয়ে আসতে চান, যদি কৃষিক্ষেত্র কৃষক ও কৃষককুলকে আলোকিত জগতের উদার প্রাঙ্গনে দাঁড় করতে চান, তাহলে আজই কৃষি ব্যবস্থার বৈপ্লবিক সংস্কার আশু প্রয়োজন।

আমাদের বাংলাদেশ ছোট্ট একটি ভুখন্ড। যার আয়তন মাত্র ৫৫ হাজার বর্গমাইল। লোকসংখ্যা প্রায় আঠারো কোটি। জনসংখ্যা হু হু করে বেড়েই চলেছে কিন্তু ভুখন্ডের আয়তন বাড়ছে কি? অবশ্যই বাড়ছে না। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে জমির পরিমাণ আস্তে আস্তে কমছে এবং ক্রমান্বয়ে কমতেই থাকবে। এটাই সত্য ও বাস্তব। আর এই বাস্তবতাকে রোধ করা সম্ভব নয়। সেহেতু ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক ও সমাজ ব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে হবে। এ লক্ষ্যে জ্ঞান, মেধা, মনন ও সৃজনশীলতার চাষ করতে হবে। সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে বিজ্ঞানের আদান প্রদান না করতে পারলে অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। তাই আমাদের দেশে চাষাবাদে সমস্ত পৃথিবীর জ্ঞান প্রয়োগ অপরিহার্য। চাষীর লাঙ্গলের ফলার সঙ্গে মাটির সম্পর্কের মতোই সমস্ত দেশের জ্ঞান, বুদ্ধি বিদ্যা ও অধ্যবসায়ের সঙ্গে স্থাপন করতে হবে। তবেই সাফল্য অর্জন করা সম্ভব।

ব্যর্থ হলে গোটা বিশ্বে যেমন আমাদের পচনশীল রাজনীতির দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে ঠিক তেমনি অন্ন বস্ত্র ও পেট নামক নরক যন্ত্রণায় অর্ধহারে, অনাহারে, ভুখা মানুষগুলো চলমান দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের সাথে একাকার হয়ে যাবে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বের মধ্যে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসীর শীর্ষস্থান দখল করবে আমাদের মাতৃভুমি বাংলাদেশ। এ-হীন ভবিষ্যতের হাত থেকে যদি জাতিকে বাঁচাতে চান, তা হলে কৃষি বিপ্লবের পাশাপাশি শিল্পায়নের ব্যাপক বিকাশ ঘটাতে হবে। শিল্পায়নের ব্যাপক বিকাশের মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে জনশক্তিতে রুপান্তরিত করতে হবে। মনে রাখবেন মেধা ও শ্রমই মুক্তির একমাত্র পথ। মেধা ও শ্রমের সংযোগ ছাড়া জাতির উন্নয়ন অগ্রগতি, স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা মোটেই সম্ভব নহে। এ জন্য প্রয়োজন সুস্থ্য রাজনীতি, স্থিতিশীল সংসদ ও দুর্নীতি মুক্ত দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো এবং স্বার্থহীন চিন্তা-চেতনা ও আদর্শ। এছাড়াও দেশ মাতৃকার প্রতি থাকতে হবে অপ্রতিরোধ্য ভালবাসা। অপ্রতিরোধ্য ভালবাসাই সকল সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on tumblr
Tumblr
Share on telegram
Telegram

বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

যায়যায়কাল এর সর্বশেষ সংবাদ