শুক্রবার, ১৩ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ,২৭শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

এর সর্বশেষ সংবাদ

ইসরাইলকে শায়েস্তা করতে ইরান কেন দেরি করছে? 

যায়যায়কাল ডেস্ক: মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরাইলের মধ্যকার উত্তেজনা নতুন কিছু না। বছরের পর বছর ধরে দেশ দুটি রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ্বে লিপ্ত। আর এই সংঘাত ও দ্বন্দ্বের তীব্রতা ভূ-রাজনৈতিক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে কখনও বাড়ে আবার কখনও কমে। বলতে গেলে যা মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার অন্যতম একটি কারণ এটি।

তেহরানের কাছে ইসরাইল হলো ‘ছোট শয়তান’ আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তারা ডাকে ‘বড় শয়তান’ বলে।

অন্যদিকে ইসরাইলের অভিযোগ ইরান ‘সন্ত্রাসী’ গোষ্ঠীকে অর্থায়নের পাশাপাশি ইহুদি বিরোধিতাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে তাদের বিরুদ্ধে হামলা চালায়।

এসব নিয়ে মাঝে মধ্যেই দেখা যায় দেশ দুটি একে অন্যের স্থাপনা, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট ও গুপ্ত হামলা চালাতে।
এ ধরনের হামলার কারণে বিপুল সংখ্যক হতাহতের ঘটনা ঘটলেও প্রায়শই দেখা যায় কোনো সরকারই এর দায় স্বীকার করে না।

তবে সম্প্রতি ইরানের রাজধানী তেহরানে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়ার হত্যাকাণ্ডের পর উত্তেজনার পাদর চরমে উঠে।

এ ঘটনার পর ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার প্রকাশ্য হুমকি দিয়েছিল ইরান। বলেছিল, ইসরাইলকে ‘শাস্তি’ দেওয়া হবে। তবে সেই ঘোষণার প্রায় এক মাস পেরিয়ে গেলেও ইসরাইলকে শাস্তি দিতে ইরানি তোড়জোড় খুব এক লক্ষ্য করা যায়নি।

গত সপ্তাহে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) মুখপাত্র বলেন যে, ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইরানের প্রতিশোধমূলক হামলা দীর্ঘ সময় নিতে পারে। ফলে ইরান কবে ইসরাইলে হামলা চালাবে সেই বিষয়টি নিয়ে নতুন করে অনিশ্চয়তা শুরু হয়।

এর আগে, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে হামলা চালিয়ে দেশটির দুই শীর্ষ কমান্ডারকে হত্যা করে ইসরাইল। ইরান ত্বরিত সেই হামলার জবাব দিয়েছিল। ৩ শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের ঝাঁকের সাহায্যে ইরান ইসরাইলে আক্রমণ করেছিল। কিন্তু এবার হানিয়ার হত্যাকাণ্ডের পর ইরানের প্রতিশোধ নিতে বিলম্ব করার বিষয়টি তেহরানের বর্তমান কৌশল সম্পর্কে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।

ইরান কেন ইসরাইলে হামলা করার বিষয়টি নিয়ে দ্বিধান্বিত—তা ব্যাখ্যা করতে বিশ্লেষকেরা কয়েকটি পয়েন্ট সামনে হাজির করেছেন। সেগুলোর মধ্যে প্রধান একটি কারণ হলো, ইসরাইলের শক্তিশালী প্রতিক্রিয়ার ভয়ে ইরান হয়তো দ্বিধান্বিত এবং এই হামলার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি সরাসরি জড়িত হয়ে পড়ে তবে তা একটি বিস্তৃত সংঘাতে পরিণত হতে পারে। দ্বিতীয়ত, ইরানের বর্তমান নেতৃত্ব—যার সর্বোপরি ইরানের ক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখাকে অগ্রাধিকার দেয়—সম্ভবত এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার বিষয়ে সতর্ক যা তাদের নিয়ন্ত্রণকে দুর্বল করতে পারে।

বোস্টন ইউনিভার্সিটির ফ্রেডরিক এস পারডি সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব দ্য লং-রেঞ্জ ফিউচারের ভিজিটিং ফেলো আরাশ আজিজি বলেন, ইরানের অনেকেই—দেশটির রাজনৈতিক শ্রেণির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বসহ—দেশটির নেতৃত্বকে সর্বাত্মক যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করছেন যা দেশের জন্য সত্যিকার অর্থে ধ্বংসাত্মক এবং সরকারের জন্য মারাত্মক হতে পারে।

এছাড়া ইরানের জলসীমার কাছাকাছি মার্কিন সামরিক উপস্থিতিও হয়ত তেহরানকে বিরত রাখতে বাধ্য করছে।

মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ পেন্টাগনের মতে, এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি ইরানের নেতাদের চিন্তাভাবনাকে ঠান্ডা করে দিয়েছে।
ইরান এর আগেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর বিষয়টি তীব্রভাবে এড়িয়ে গেছে। এর একটি প্রমাণ হলো—ইরানের আল-কুদস ফোর্সের প্রধান কাসেম সুলাইমানিকে ২০২০ সালে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু তখনও ইরান যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। এমনকি কাসেম সুলাইমানির ব্যাপক গুরুত্ব থাকার পরও ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাতে জড়ানো থেকে বিরত ছিল।

ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইরানের আক্রমণাত্মক অবস্থান নেওয়া থেকে বিরত থাকার আরেকটি কারণ হতে পারে, ইসরাইল-হামাসের মধ্যে গাজায় যুদ্ধবিরতি আলোচনা। ইরান চায় না এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে যা এই আলোচনাকে লাইনচ্যুত করতে পারে। এ ছাড়া, এমনটা করে ইরান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে দোষী হিসেবেও বিবেচিত হতে চায় না।

আগামী নভেম্বরে হতে যাওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়েও সতর্ক ইরান। তেহরানে ক্ষমতাসীনরা এমন কিছু করতে চায় না যার ফলে, যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার বিষয়টিই ত্বরান্বিত হয়। কারণ, বর্তমান বাইডেন প্রশাসন ইরানের ব্যাপারে যতটা নমনীয় ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়তো তার চেয়েও অনেক বেশি আগ্রাসী মনোভাব দেখাবে। যার প্রমাণ নিকট অতীতেই পাওয়া গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক এবং ইউনাইটেড অ্যাগেইনস্ট নিউক্লিয়ার ইরানের সিনিয়র উপদেষ্টা সাইদ গোলকার বলেন, ইসরাইলের সঙ্গে ইরানের যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রকে একটি বড় সংঘর্ষে টেনে আনবে, যা নভেম্বরের নির্বাচনে কমলা হ্যারিসের নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করতে পারে। ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইরান ট্রাম্পকে আবার নির্বাচিত হওয়া থেকে আটকাতে যা প্রয়োজন নিজের তরফ থেকে, তার সবটাই করবে।

তবে এতগুলো শর্ত বা কারণ হাজির থাকার পরও হয়ত ইরান, ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে বাধ্য। বিশেষ করে নিজের মাটিতে মিত্র গোষ্ঠীর শীর্ষ নেতা গুপ্তহত্যার শিকার হওয়ার পর বিষয়টি ইরানের জন্য ইজ্জতের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি গত এপ্রিল ইরান ইসরাইলে যে প্রতীকী আক্রমণ চালিয়েছিল, সে ধরনের কোনো আক্রমণ চালিয়ে হলেও প্রতিশোধ নিতে হবে বাধ্য ইরান। তবে এবারে এপ্রিলে ইরান ইসরাইলে যে হামলা চালিয়েছিল তার মতো ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন সরাসরি ব্যবহার করা নাও হতে পারে।

সব মিলিয়ে ইরান এখনও কিছুটা দ্বিধান্বিত। বিশেষ করে কীভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ এড়িয়ে ইসরাইলি আগ্রাসনকে বাধা দেওয়া যায়—সেই বিষয়টি নিয়ে ইরান অনেক বেশি দ্বিধান্বিত। বর্তমানে ইরানের নেতৃত্ব এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে, দেশটির সমর্থকদের প্রত্যাশা এবং বাস্তবতার মাঝে যে দূরত্ব সেটি কীভাবে মেটানো যায় সেটিই এখন তেহরানের মূল চিন্তা।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Tumblr
Telegram

বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

যায়যায়কাল এর সর্বশেষ সংবাদ