যায়যায় কাল প্রতিবেদক : রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার ও নির্বাচনের রূপরেখা তৈরিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম দফা আলোচনা শেষ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সরকারের সঙ্গে আলোচনায় দলগুলো রাষ্ট্র সংস্কারের নানা প্রস্তাব তুলে ধরেছে। নির্বাচন কবে হবে, সে ব্যাপারে একটি রূপরেখা বা রোডম্যাপ দেওয়ার তাগিদ দিয়েছে প্রায় সব রাজনৈতিক দল।
অন্যদিকে সরকার বলেছে, দলগুলোর সঙ্গে এ আলোচনায় যেসব সংস্কারের প্রস্তাব এসেছে, সেগুলোর ভিত্তিতে সরকার নির্বাচনের একটি রূপরেখা তৈরি করবে। এটি চূড়ান্ত করার আগে আরেক দফা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা হবে।
গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের পতন হয় ৫ আগস্ট। এরপর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। ইতিমধ্যে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল পরবর্তী নির্বাচন কবে হবে—এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
গত বৃহস্পতিবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলটির নেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেন। গতকাল শনিবার আলোচনায় অংশ নেন ৯টি রাজনৈতিক দল ও দুটি জোটের নেতারা। তবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্রদের এই আলোচনায় ডাকা হয়নি। যদিও জাতীয় পার্টিকে মতবিনিময়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
শনিবার জাতীয় পার্টিসহ বেশ কিছু ইসলামপন্থী দল সংলাপে অংশ নেয়। প্রায় সব দলই একটি নির্বাচনী রূপরেখা দেওয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছে। কোনো কোনো দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের পক্ষে মত দেয়। সংবিধান সংশোধন এবং দুই মেয়াদের বেশি কেউ যাতে প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন, সেই বিষয়েও প্রস্তাব দেন কোনো কোনো দলের নেতারা।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সরকারের মাত্র তিন সপ্তাহ হলো। দলগুলো কী চায়, মতবিনিময়ে তা জানতে চাওয়া হয়। সবাই সরকারের ওপর আস্থা প্রকাশ করছে। টেকসই সংস্কার দেখবেন বলে দলগুলোর নেতারা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
এর আগে সরকার গঠনের চার দিনের মাথায় গত ১২ ও ১৩ আগস্ট বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ কিছু দলের সঙ্গে বৈঠক করে অন্তর্বর্তী সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল অন্য দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সরকার।
শনিবার বেলা ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ৯টি দল ও দুটি জোটের নেতাদের সঙ্গে একের পর এক বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ প্রক্রিয়ায় ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরামের একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মতবিনিময় করে।
সেই বৈঠকের পর দলের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। দলটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রস্তাবও দিয়েছে। সংবিধান সংশোধন করা এবং বিভিন্ন খাতে সংস্কারকাজে যতটা সময় প্রয়োজন, সেই সময় দিতে চেয়েছে গণফোরাম।
জাতীয় পার্টিও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, একই ব্যক্তি যাতে দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন, এসব সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে। দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ওই আলোচনায় অংশ নেয়। বৈঠক শেষে জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক সাংবাদিকদের বলেন, সংস্কারগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে পরে নির্বাচনের যেতে পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে একটা রূপরেখা ঘোষণার তাগিদ দিয়েছেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম। বৈঠক শেষে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘ওনারা (অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে) যদি বেশি সময় নেয়, ওনাদের পক্ষে সরকার পরিচালনা করা সম্ভব হবে না।’
বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মতবিনিময় করে অলি আহমদের নেতৃত্বে এলডিপির প্রতিনিধিদল। অলি আহমদ আরও বলেন, ‘আমরা বলেছি, রাজনৈতিক দলকে ব্যস্ত রাখতে একমাত্র উপায় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা দিয়ে দেওয়া। এটা ছয় মাস পর হতে পারে, নয় মাস পরও হতে পারে। নির্বাচন তো হতে হবে। তবে সংস্কার হওয়ার আগে কোনো নির্বাচন বাঞ্ছনীয় নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এলডিপির পক্ষ থেকে বিভিন্ন খাতে সংস্কারের মোট ৮৩টি সুপারিশ করা হয়েছে।
হেফাজতে ইসলাম ও ৬টি ইসলামি দলের নেতারা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদে এক ব্যক্তির দুই মেয়াদের বেশি না থাকার প্রস্তাব দিয়েছেন। পাশাপাশি একটা যৌক্তিক সময় নিয়ে সংস্কারগুলো করে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করতে বলেছেন তারা।
বৈঠক শেষে বেরিয়ে বিকেল চারটার দিকে হেফাজতে ইসলামের নেতা ও বাংলাদেশ খেলাফতে মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, নির্বাচনে অযথা কালবিলম্ব যেন না করা হয়, সেটা উল্লেখ করেছেন।
বৈঠকে হেফাজতে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফতে মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, নেজামে ইসলাম ও খেলাফত আন্দোলনের নেতারা যোগ দেন।
জনগণ ‘অস্থির’ হওয়ার আগে নির্বাচন দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। একই সঙ্গে নির্বাচন কবে হবে, কীভাবে হবে, তার একটা রূপরেখা দিতেও প্রধান উপদেষ্টাকে অনুরোধ করেছে দলটি। যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন ইসলামী আন্দোলনের আমির ও চরমোনাই পীর সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম ও দলটির সিনিয়র নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম।
দলগুলোর সঙ্গে এসব বৈঠকের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব সফিকুল আলম এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, দলগুলোর কাছে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘রাষ্ট্র মেরামত করার জন্য এটা জাতির জন্য সুবর্ণ সুযোগ, এর সৎ ব্যবহার করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি যাতে সংস্কার করতে পারি, এটা যাতে অনেক বছর থাকে। দেশের মানুষ যাতে সুফল উপভোগ করতে পারে।’ সংবিধানের সংস্কার হবে নাকি পুনর্লিখন হবে, এ বিষয়েও দলগুলোর মতামত জানতে চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
সফিকুল আলম জানান, অনেকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলেছেন। অনেকে বলেছেন, দুবারের বেশি যাতে কেউ প্রধানমন্ত্রী না থাকতে পারেন। ইসলামি দলগুলো বলেছে, তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। ২০১৩, ২০১৬ ও ২০২১ সালে হেফাজতের আন্দোলনে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের জন্য স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছে ইসলামি দলগুলো। শিক্ষানীতির আমূল সংস্কার চেয়েছে ইসলামি দলগুলো। প্রেস সচিব উল্লেখ করেন, কিছু কিছু বিষয়ে আবার নতুন করে প্রস্তাব দিতে প্রধান উপদেষ্টা ও অন্য উপদেষ্টারা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সফিকুল আলম বলেন, সংস্কার প্রস্তাবের ওপর নির্ভর করবে, যৌক্তিক সময়টা কী। সময় নিয়ে কেউ কিছু বলেননি। সবাই বলেছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাবে। সবাই আস্থা প্রকাশ করছেন। টেকসই সংস্কার দেখবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
যৌক্তিক সময়ের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেন, ‘জনগণের কাছেই ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। এর আগে অগ্রাধিকার অনুযায়ী সংস্কার হবে। সংস্কারের প্রস্তাবের ওপর নির্ভর করবে, কত সময় লাগবে। আগে প্রস্তাবগুলো আসুক। এর ভিত্তিতে রূপরেখা হবে বলে আশা করছি। ওই রূপরেখাতেই বলা হবে, কখন ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।’