
স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম: কুড়িগ্রামের রাজারহাটে এস এ বাবলু নামে এক যুবক আওয়ামী লীগের আমলে চাঁদাবাজি করে কোটিপতি বনে গেছেন। তার আসল নাম সেকেন্দার আলী বাবলু। আগে তাকে ‘আর্ট বাবলু’ নামেই মানুষ চিনতো।
তিনি রাজারহাট সদর ইউনিয়নের দিনা মৌজার চান্দিয়াপাড়া গ্রামের মৃত শরিফ উদ্দিনের ছেলে। প্রায় ৩৫ বছর আগে সিংগেরডাবরী এলাকা থেকে পেটের দায়ে বাবলু রাজারহাট বাজারে এসে ‘বেলী সাইন’ নামের সাইনবোর্ড লেখা ও ছবি বাঁধাইয়ের দোকান দিয়ে বসেন। সেখান থেকে তার উত্থান শুরু হয়।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০১ সালে ক্ষমতায় এলে কয়েকজন পাতি নেতার ছত্রছায়ায় নামমাত্র স্থানীয় পত্রিকার একটি কার্ড সংগ্রহ করে সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্ন বুনেন। ধীরে ধীরে তিনি আওয়ামী লীগের ছত্র ছায়ায় প্রেসক্লাবের সভাপতির পদ লুফে নিয়ে নানান অপকর্মে জড়িত হয়ে রাতারাতি ‘আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ’ হয়ে উঠেন। তার সম্পদ ও সম্পত্তির হিসেব নিলেই বেরিয়ে আসবে থলের বিড়াল- বলে দাবি করেন সচেতন মহল।
এক সময় সাইনবোর্ড লেখা ব্যবসার পাশাপাশি জাল সার্টিফিকেট তৈরির ব্যবসা ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। একারণে বেশ কয়েকবার পুলিশের অভিযানও চলছিল তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু বাবলু তখন সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলেন। এরপর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তরতর করে এগিয়ে গেছেন। বর্তমানে তিনি বিভিন্ন স্থানে নিজেকে বিএনপির সমর্থক বলে প্রচার করলেও আওয়ামী শাসনামলে তার দাপট ছিল চোখে পড়ার মতো। আওয়ামী লীগের আমলে কি প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল না তার! সুবিধা নিতে যখন যাকে যেভাবে ব্যবহার করা প্রয়োজন সেকাজে তিনি সিদ্ধহস্ত।
এস এ বাবলু ছিলেন প্রেসক্লাবের সভাপতি। রাজারহাট উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক রফিকুল ইসলামের সাথে তার সখ্যতায় তিনি চাঁদাবাজিসহ নানান অপকর্মে ছিলেন পটু। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় প্রেসক্লাবের দাপট দেখিয়ে অবৈধ আয় রোজগার দিয়ে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। এ যেন আলাউদ্দিনের চেরাগ!
অনুসন্ধানে জানা যায়, আর্ট বাবলুর এখন কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। এর মধ্যে অন্যতম বেলী সাইন ইলেট্রনিক্স শো রুম( ওয়ালটন শোরুম), হিরো মটরস, এশা শোরুম, গ্লামার শোরুম, ডাচ্ বাংলা এজেন্ট ব্যাংকিং, বেলী সাইন বিকাশ-রকেট, রাজারহাট ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি, সিঙ্গেরডাবরী হাট সমবায় সমিতিসহ নামে-বেনামে তার কয়েকটি সমিতি রয়েছে। যেখানে অবৈধ পন্থায় গ্রাহক সংগ্রহ করে ঋণ দিয়ে থাকেন জনসাধারণকে। মূলত তিনি এসব ব্যবসায় দিয়ে অবৈধ সুদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি প্রেসক্লাবের সভাপতির দাপটে।
এ কারণে আওয়ামী লীগের শাসনামলে রক্তচক্ষুর ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছিলেন না। কেউ কিছু বলে উঠার আগেই তাকে আওয়ামী লীগের পোষা বাহিনী দিয়ে তুলে নিয়ে এসে প্রেস ক্লাবে টর্চার চালাতেন। কয়েক বছর আগে ডাচ্ বাংলা এজেন্ট ব্যাংকিং সিঙ্গের ডাবরী অফিসের কর্মকর্তাকে হত্যার অভিযোগ উঠেছিল এই বাবলুর উপরে। ধামাচাপা দিয়ে অর্থের বিনিময়ে সে যাত্রাও তিনি পাড় পান।

৫ আগস্টের পর দেশ স্বৈরাচার মুক্ত হলে ‘আর্ট বাবলুর’ মুখোস উম্মোচন করতে থাকেন সাধারন মানুষ। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে রাজারহাট থানায় একটি চাঁদাবাজি মামলা দায়ের করেন এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক। এদিকে প্রেসক্লাব রাজারহাটের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী একই ব্যক্তি টানা দু’বারের বেশি সভাপতি, সম্পাদকের পদে থাকতে পারেন না। এই নীতিতে তিনি প্রেসক্লাবের সভাপতি মনোনীত হন। এরপর পুনরায় তাকে সভাপতি হিসেবে সময় দেন ক্লাবের সদস্যগণ। এসময় লাগামহীন চাঁদাবাজিতে মেতে উঠেন তিনি। পুরোপুরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির ছত্রছায়ায় চলে যান।
উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক রফিকুল ইসলামের যোগসূত্রে বাবলু আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন। রাজারহাট উপজেলা বিভিন্ন সেক্টর থেকে তার মাসোহারা আসতো। চাঁদাবাজি করতেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এলাকার বালু উত্তোলনের প্রকল্প, এনজিও থেকে। অথচ তার নিজের আদ্যিখেতা ও বাহাদুরি দেখে সাধারণ মানুষ তাকে জমিদার ভাবতো।
প্রেসক্লাবের তৃতীয়বারের নির্বাচনে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নির্বাচনের নির্ধারিত দিনের আগের দিন একটি সাজানো নির্বাচন দেখিয়ে অবৈধভাবে সভাপতি হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দেন। এছাড়া এস এ বাবলু একজন সমবায়ী পরিচয় দিয়ে গ্রামের সহজ সরল মানুষকে ঠকাচ্ছে। সমবায়ে আমানত সংগ্রহ করার বিধান না থাকলেও তারা সাধারণ মানুষ কে ভুল বুঝিয়ে উচ্চ লাভের লোভ দেখিয়ে আমানত সংগ্রহ এবং ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাচ্ছে। সমিতিতে কর্মরত জনৈক মহিলা কর্মীর সাথে তার যৌন সম্পর্কের কথা চাউর হয়ে গেছে। সমবায় সমিতিতে প্রতিজন সদস্য শেয়ার হোল্ডার হিসেবে বিবেচিত হলেও রাজারহাট ব্যবসায়ি উন্নয়ন সমবায় সমিতি কোন সদস্য কে শেয়ার সার্টিফিকেট দেয়া হয় না।
এ ব্যাপার উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা মো. শাহ আলম জানান, শেয়ার সার্টিফিকেট দেয়ার প্রচলন সমিতিটি এখনও চালু করেনি। চাঁদাবাজির অভিযোগ রফিকুল ও বাবলুর বিরুদ্ধে বরাবরই ছিল। কিন্তু কেউ মুখ খোলার সাহস পায়নি। ৫ আগস্টের পর বাজারহাট উপজেলার একজন প্রধান শিক্ষক বিগত দিনে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ এনে রাজারহাট থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা রুজুর দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেছে কিন্তু অদ্যাবধি আসামিদের কেউ গ্রেফতার হয়নি। অথচ আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।