
মো. নাজমুল ইসলাম: বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। শত শত নদী এই দেশের ভূ-প্রকৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এগুলোর মধ্যে অনেক নদী একসময় প্রবল স্রোতস্বিনী ছিল, কিন্তু কালের পরিক্রমায় নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে।
নেত্রকোণা জেলার অন্যতম প্রধান নদী মগড়া। যা একসময় প্রবল গতিশীল ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা হারিয়ে ফেলছে তার প্রাণ। নদীটি ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে জলাবদ্ধতা, কৃষি উৎপাদনে সমস্যা, পরিবেশগত বিপর্যয়সহ নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে মগড়া নদী খনন করা একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
এই নদী জেলার কৃষি, পরিবহন এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি একসময় প্রবল স্রোতধারায় প্রবাহিত হতো এবং আশপাশের মানুষের জীবন-জীবিকার অন্যতম উৎস ছিল। কিন্তু বর্তমানে নদীটি ধীরে ধীরে তার গতি হারাচ্ছে, দখল ও দূষণের শিকার হচ্ছে, ফলে নদীটির অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়েছে।
মগড়া নদীর গুরুত্ব বিবেচনায় নিতে গেলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো প্রাসঙ্গিক
সেচ ব্যবস্থা: কৃষিকাজের জন্য পানি সরবরাহে এই নদী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পরিবহন: একসময় এই নদী দিয়ে নৌপথে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন হতো, যা এখন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
জীববৈচিত্র্য: নদীর পানি এবং তীরবর্তী পরিবেশ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, পাখি ও জলজ উদ্ভিদের আবাসস্থল।
প্রাকৃতিক ভারসাম্য: মগড়া নদী এলাকার জলবায়ুর ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে, যা বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের ভারসাম্য রক্ষা করে।
মগড়া নদীর বর্তমান অবস্থা খুবই নাজুক। বর্তমানে মগড়া নদী তার স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়েছে। এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—
নদীর নাব্যতা হ্রাস: প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট নানা কারণে নদীটি ক্রমশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পলি জমে নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে গেছে, যার ফলে বর্ষাকালে বন্যা ও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় এবং শুকনো মৌসুমে পানি সংকট দেখা দেয়।
দখল ও দূষণ: নদীর আশপাশে বসবাসকারী লোকজন বিভিন্নভাবে নদী দখল করে বসতি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। এছাড়া শিল্প ও গৃহস্থালির বর্জ্য ফেলার কারণে নদীর পানি দূষিত হয়ে পড়েছে, যা মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে।
বৃষ্টির পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া: নদী ভরাট হওয়ার কারণে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে বর্ষার সময় পানি বের হতে পারে না এবং বন্যার সৃষ্টি হয়। আবার শুষ্ক মৌসুমে পানি কমে যাওয়ায় কৃষিকাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি: নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ার কারণে মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে। এতে স্থানীয় জেলেদের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। পাশাপাশি নদী তীরবর্তী বৃক্ষরাজি কমে যাওয়ায় পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে মগড়া নদী খনন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই খননের ফলে বিভিন্ন ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। যেমন—
নদীর নাব্যতা পুনরুদ্ধার: খনন কাজের মাধ্যমে নদীর তলদেশ থেকে পলি অপসারণ করা হলে নদী তার স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরে পাবে। এতে বর্ষাকালে পানি নিষ্কাশনের পথ খুলবে এবং বন্যার ঝুঁকি কমবে।
কৃষিতে ইতিবাচক প্রভাব: নদীতে পর্যাপ্ত পানি থাকলে কৃষিকাজে সেচ সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। শুষ্ক মৌসুমে কৃষকরা পানির অভাবে ফসল ফলাতে পারে না, যা খননের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব হবে।
নৌপরিবহন পুনরুদ্ধার: একসময় এই নদীর মাধ্যমে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন হতো। খননের ফলে পুনরায় নৌপরিবহন চালু করা সম্ভব হবে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
জলাবদ্ধতা নিরসন: নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে আশপাশের অঞ্চলে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। খননের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান হবে, যা কৃষি, বসবাস ও পরিবেশের জন্য উপকারী হবে।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ: খননের মাধ্যমে নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ ফিরে এলে মাছসহ জলজ প্রাণীরা টিকে থাকতে পারবে। ফলে জেলেরা আবার মাছ ধরার সুযোগ পাবে এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষিত হবে।
পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা: নদী খনন করা হলে তীরবর্তী বনাঞ্চল পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে। যা পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখবে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ থাকলে বাতাসে আর্দ্রতা বজায় থাকবে, যা স্থানীয় জলবায়ুর ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তবে মগড়া নদী খননের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও এর বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা গেলে খনন কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।
অর্থায়নের অভাব: সরকারি বরাদ্দ ছাড়া নদী খনন করা কঠিন। এজন্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ: নদীর তীর দখল করে বসবাস ও ব্যবসা করা ব্যক্তিদের উচ্ছেদ করা কঠিন কাজ। এজন্য প্রশাসনিক কঠোরতা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন।
টেকসই খনন পরিকল্পনার অভাব: কেবল একবার খনন করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির মাধ্যমে নদীর নাব্যতা ধরে রাখতে হবে।
মগড়া নদী খনন সময়ের দাবি। এটি শুধুমাত্র একটি নদীর পুনরুদ্ধার নয়, বরং এটি কৃষি, নৌপরিবহন, জলজ প্রাণী এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নদী খননের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, জলাবদ্ধতা নিরসন, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সম্ভব হবে। এজন্য সরকারি উদ্যোগ, জনগণের সচেতনতা এবং টেকসই পরিকল্পনার মাধ্যমে এই কাজ দ্রুত বাস্তবায়ন করা জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক