সোমবার, ২৩শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ,৭ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

এর সর্বশেষ সংবাদ

ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের মারছে ইসরায়েল

যায়যায়কাল ডেস্ক: গাজায় ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত বিতর্কিত ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) সাবেক এক নিরাপত্তা ঠিকাদার বলেছেন, তিনি কয়েকবার তার সহকর্মীদের মেশিনগানসহ অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালাতে দেখেছেন, যারা কোনো হুমকি ছিল না।

তিনি বলেন, একবার নারী, শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিদের একটি দল ত্রাণকেন্দ্র থেকে ফিরে যাওয়ার সময় শুধু ধীরে চলার কারণে একজন প্রহরী ওয়াচটাওয়ার থেকে তাদের ওপর মেশিনগান দিয়ে গুলি চালায়।

বিবিসির প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

এ বিষয়ে জিএইচএফ’র মন্তব্য জানতে চাইলে, অভিযোগগুলো পুরোপুরি মিথ্যা বলে দাবি করে তারা।

একটি বিবৃতির উদ্ধৃতি দিয়ে তারা আরও জানায়, জিএইচএফ’র ত্রাণকেন্দ্রগুলোতে কোনো বেসামরিক নাগরিকের ওপর কখনোই গুলি চালানো হয়নি।

মে মাসের শেষের দিকে দক্ষিণ ও মধ্য গাজার বেশ কিছু এলাকায় সীমিতভাবে ত্রাণ বিতরণের মাধ্যমে গাজায় নিজেদের কার্যক্রম শুরু করে জিএইচএফ। এরপর গাজায় ১১ সপ্তাহের পূর্ণ অবরোধ আরোপ করে ইসরায়েল, তখন থেকে ওই এলাকায় আর কোনো খাদ্যসামগ্রী প্রবেশ করেনি।

শুরু থেকেই জিএইচএফ’র ত্রাণ বিতরণব্যবস্থা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। কেননা এর ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষকে সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে হেঁটে অল্প কয়েকটি কেন্দ্রে যেতে বাধ্য করা হচ্ছিল।

জাতিসংঘ ও স্থানীয় চিকিৎসকরা জানান, জিএইচএফ’র কার্যক্রম শুরুর পর থেকে ত্রাণ নিতে যাওয়া চারশ’র বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল।

যদিও ইসরায়েলের দাবি, নতুন এই বিতরণব্যবস্থা চালুর ফলে হামাসের হাতে ত্রাণ পৌঁছানো বন্ধ হয়েছে।

জিএইচএফ’র একটি কেন্দ্রে ফিলিস্তিনি সেই দলের ওপর প্রহরীদের গুলি চালানোর ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ওই ঠিকাদার বলেন, ‘ঘটনার সময় আরেক ঠিকাদার, যিনি কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে ভিড়ের ওপর ১৫ থেকে ২০টি গুলি চালান।’

‘এতে একজন ফিলিস্তিনি মাটিতে লুটিয়ে অসাড় হয়ে যান। সেসময় পাশে থাকা আরেক ঠিকাদার বলে ওঠেন, ‘দারুন, মনে হয় তুমি একজনকে নিশানা করে ফেলেছ।’ এরপর তারা এ নিয়ে হাসাহাসিতে মেতে ওঠেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই ঠিকাদার আরও জানান, ঘটনাটি জিএইচএফ’র ব্যবস্থাপকদের জানানো হলে তারা বিষয়টিকে কাকতালীয় ঘটনা বলে উড়িয়ে দেন এবং বলেন যে, ফিলিস্তিনি লোকটি হয়তো হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছেন বা ক্লান্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন।

তবে জিএইচএফ দাবি করেছে যে, অভিযোগকারী একজন ‘অসন্তুষ্ট সাবেক ঠিকাদার’, যাকে অসদাচরণের জন্য বরখাস্ত করা হয়েছিল।

তবে তিনি তা অস্বীকার করেন এবং প্রমাণ দেখান যে, তিনি সম্মানজনকভাবে চাকরি ছেড়েছেন।

ওই ঠিকাদার জানান, তিনি জিএইচএফ’র চারটি ত্রাণকেন্দ্রেই কাজ করেছেন। তার ভাষ্যে, সেখানে কোনো নিয়ম-কানুন বা নিয়ন্ত্রণ নেই, যা দায়মুক্তির সুযোগ করে দেয়।

তিনি বলেন, ঠিকাদাররা কীভাবে কাজ করবেন তার সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়মকানুন ছিল না। সেখানে এক দলনেতা তাদের বলেছিলেন, ‘যদি হুমকি অনুভব করো, তাহলে গুলি করো—মেরে ফেলো, পরে প্রশ্ন করো।’

প্রতিষ্ঠানটির সংস্কৃতি সম্পর্কে তিনি বলেন, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছিল যে- ‘আমরা গাজায় যাচ্ছি, সুতরাং এখানে কোনো নিয়ম নেই। যা খুশি তা–ই করো।’

ওই ঠিকাদার আরও বলেন, ‘যদি এমন হয় যে কোনো ফিলিস্তিনি ত্রাণকেন্দ্র থেকে চলে যাচ্ছেন এবং তার মধ্যে শত্রুতাপূর্ণ কোনো আচরণ পরিলক্ষিত না হওয়া সত্ত্বেও আমরা যদি তাকে লক্ষ্য করে সতর্কতামূলক গুলি ছুড়ি, তাহলে আমরা ভুল, এটা অপরাধ। এর দায় এড়ানো যায় না।’

তিনি বলেন, ‘প্রতিটি কেন্দ্রেই সিসিটিভি ক্যামেরা দ্বারা পর্যবেক্ষণ করা হতো। জিএইচএফ যদি বলে কেউ আহত বা গুলিবিদ্ধ হয়নি, সেটা একেবারে নির্লজ্জ মিথ্যা।’

জিএইচএফ বলেছে, বিবিসিকে দেওয়া ভিডিওতে যে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে, সেটি ইসরায়েলি বাহিনীর গুলি।

সাবেক ওই ঠিকাদার বলেন, দলনেতারা গাজার বাসিন্দাদের ‘জম্বির ঝাঁক’ বলে ডাকতেন। এর মানে হলো- এই মানুষগুলোর জীবনের কোনো মূল্য নেই।

তিনি বলেন, জিএইচএফ’র ত্রাণকেন্দ্রগুলোতে ফিলিস্তিনিরা আরও নানাভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। যেমন: স্টান গ্রেনেডের ধ্বংসাবশেষের আঘাত পেয়ে, ঝাঁঝালো স্প্রে-তে আক্রান্ত হয়ে কিংবা ভিড়ের চাপে কাঁটাতারে পড়ে গিয়ে।

ফিলিস্তিনিদের বেশ কয়েকবার গুরুতর আহত হতে দেখেছেন তিনি। যেমন: একবার এক পুরুষের মুখে পিপার স্প্রের পুরো ক্যানই ঢেলে দেওয়া হয়েছিল। আরেক নারী স্টান গ্রেনেডের ধাতব অংশে মাথায় আঘাত পান, যা ভুলভাবে ভিড়ের মধ্যে ছোঁড়া হয়েছিল।

‘ওই ধাতব টুকরাটি সরাসরি তার মাথায় লেগেছিল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং অসাড় হয়ে যান। আমি জানি না তিনি মারা গিয়েছিলেন কি না। তবে এটা নিশ্চিত যে- তিনি অচেতন ছিলেন, পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিলেন’, বলেন ওই ঠিকাদার।

এ সপ্তাহের শুরুতে অক্সফাম ও সেভ দ্য চিলড্রেনসহ ১৭০টির বেশি আন্তর্জাতিক দাতব্য এবং বেসরকারি সংস্থা একযোগে জিএইচএফের কার্যক্রম বন্ধের দাবি জানায়। তারা বলছে, ইসরায়েলি বাহিনী ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নিয়মিতভাবে ত্রাণ নিতে আসা ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালায়।

তবে ইসরায়েলের দাবি, তাদের সেনারা ইচ্ছাকৃতভাবে ত্রাণ নিতে আসা মানুষের ওপর গুলি চালায় না। জিএইচএফ ত্রাণের অভাবে থাকা মানুষদের সরাসরি সহায়তা করে, এতে হামাসের হস্তক্ষেপ এড়ানো যায়।

জিএইচএফ বলছে, তারা মাত্র পাঁচ সপ্তাহে পাঁচ কোটি ২০ লাখের বেশি খাবারের প্যাকেট বিতরণ করেছে। যেখানে অন্যান্য সংস্থার কর্মীরা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে যখন তাদের ত্রাণ লুট হয়।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। ওই হামলায় প্রায় এক হাজার ২০০ জন নিহত হন এবং ২৫১ জনকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়। এর জবাবে সেদিন থেকেই গাজায় নির্বিচার ও নৃশংস হামলা শুরু করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।

গাজার হামাসনিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৭ হাজার ১৩০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Tumblr
Telegram

বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *