বৃহস্পতিবার, ১১ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ,২৬শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আইনজীবীকে খুনের ঘটনায় ২৫ থেকে ৩০ জন অংশ নেন

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি: সাদা শার্ট ও কালো প্যান্ট পরা একজন রাস্তায় পড়ে আছেন। আশপাশে ২৫–৩০ জন যুবক। একজনের পরনে কমলা রঙের গেঞ্জি, কালো প্যান্ট, মাথায় ছাই রঙের হেলমেট। পড়ে থাকা ওই ব্যক্তিকে কিরিচ দিয়ে কোপাতে থাকেন এই হেলমেটধারী। অন্য আরও তিন-চারজন তাকে পেটাচ্ছেন। এটি পুলিশের সংগ্রহ করা একটি ভিডিওর চিত্র।

এ ঘটনা গত মঙ্গলবার বিকেলের। চট্টগ্রাম আদালত ভবনের অদূরে কোতোয়ালি থানা-সংলগ্ন সেবক কলোনির একটি বাসার সামনের রাস্তায় এভাবে পিটিয়ে-কুপিয়ে হত্যা করা হয় আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে। কিরিচ হাতে কোপাতে থাকা যুবকের নাম চন্দন দাস। পেশায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী।

পুলিশ বলেছে, শুধু চন্দন দাস নন, আইনজীবীকে খুনের ঘটনায় ২৫ থেকে ৩০ জন অংশ নেন। কোপানোয় অংশ নেন চারজন। ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজ দেখে পুলিশ ইতিমধ্যে আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে। বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যার প্রতিবাদে গতকাল বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দিনের মতো চট্টগ্রামের আদালতের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে মানববন্ধনে অংশ নেন বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা।

এ ছাড়া পুলিশের ওপর হামলায় জড়িত অভিযোগে গতকাল আরও সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

গত মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে চট্টগ্রাম আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন নামঞ্জুর হয়। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানোর জন্য প্রিজন ভ্যানে তোলা হলে বাধা দেন তাঁর অনুসারীরা। তারা প্রিজন ভ্যান আটকে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে পুলিশ, বিজিবি লাঠিপেটা করে ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

তখনই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এ সময় আইনজীবীদের গাড়ি ভাঙচুর, ইটপাটকেল নিক্ষেপের প্রতিবাদে মিছিল বের করেন কিছু আইনজীবী। একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, মিছিল শেষে ফেরার পথে হোঁচট খেয়ে রাস্তায় পড়ে যান সাইফুল। তখন তাকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

ঘটনাস্থল থেকে পুলিশের সংগ্রহ করা ৫২ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ফুটেজের সূত্র ধরে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ধারালো অস্ত্র দিয়ে আইনজীবী সাইফুলকে কোপান ওম দাশ, চন্দন ও রনব। তার নিথর দেহ পড়ে থাকলেও লাঠিসোঁটা দিয়ে বেধড়ক পেটাতে থাকেন অন্যরা। সেখানে আরও ছিলেন ২৫-৩০ জন। তাদের মধ্যে হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে রমিত দাস, সুমিত দাস, গগন দাস, নয়ন দাস, বিশাল দাস, আমান দাস, মনু মেথর ও রাজীব ভট্টাচার্যকে মঙ্গলবার রাতে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বেশির ভাগই পরিচ্ছন্নতাকর্মী। একজন রয়েছেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী।

মঙ্গলবার থেকে সেবক কলোনির বেশির ভাগ বাসিন্দা ঘরে নেই। গতকাল বিকেলে সেখানে গিয়ে কয়েকজনকে দেখা যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, ঘটনার সঙ্গে কয়েকজন জড়িত থাকলেও এখন সবাই বিপদে পড়েছেন। নিরীহ কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হন, সেই দাবি জানান তারা।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবী মো. হাসান বলেন, হামলা-ভাঙচুরের প্রতিবাদে সাইফুলসহ কিছু আইনজীবী প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে বান্ডিল রোডে যান। ওই সময় সশস্ত্র লোকজন তাদের ধাওয়া দেন। হোঁচট খেয়ে পড়ে যান সাইফুল। অন্যরা দৌড়ে প্রাণে বেঁচে যান।

কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফজলুল কাদের চৌধুরী বৃহস্পতিবার বিকেলে নিজ কার্যালয়ে বলেন, আইনজীবী হত্যাকাণ্ডে ২৫ থেকে ৩০ জন অংশ নিয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে ভিডিও ফুটেজ ও গ্রেপ্তার আসামিদের কাছ থেকে জানা গেছে। এদের বেশির ভাগকেই পুলিশ শনাক্ত করেছে। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

জড়িত আসামিদের রাজনৈতিক কোনো পরিচয় পাওয়া গেছে কি না এ বিষয়ে ওসি বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এখনো পাওয়া যায়নি।

পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় করা তিন মামলায় বৃহস্পতিবার আরও সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে কোতোয়ালি থানার পুলিশ। তারা হলেন রাজীব, ববি চৌধুরী, আবদুল কাইয়ুম, কৌশিক চৌধুরী, আবির দে, রবিন দাশ ও জুয়েল দাশ। এ নিয়ে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তারের সংখ্যা দাঁড়াল ৩৫।

আইনজীবী সাইফুল হত্যার ঘটনায় তার পরিবারের পক্ষ থেকে মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে। তবে রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত হত্যা মামলা হয়নি।

চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে ঘিরে আদালত প্রাঙ্গণের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী।

বৃহস্পতিবার দুপুরে আদালত প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের বিক্ষোভ সমাবেশে তিনি বলেছেন, পুলিশের প্ররোচনায় সেদিন হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে সব কর্মকাণ্ড আদালত ভবনে সংঘটিত হয়েছে।

নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে যখন কারাগারে নেওয়ার জন্য প্রিজন ভ্যানে তোলা হলো, তখন পুলিশ কেন নিষ্ক্রিয় ছিল। কাদের ইন্ধনে চিন্ময় কৃষ্ণকে তিন ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। তাকে হ্যান্ডমাইক দেওয়া হয়েছিল কেন। প্রিজন ভ্যান থেকে তিনি কীভাবে বক্তৃতা দিলেন। এসব বিষয়ে তদন্ত করার জন্য পুলিশ কমিশনারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’

তিনি বলেন, কারাগারে চিন্ময় দাসকে দেওয়া ডিভিশন প্রত্যাহার করতে হবে। নইলে কারাগার ঘেরাও করা হবে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) কাজী তারেক আজিজ বলেন, পুলিশ সর্বোচ্চ পেশাদারি ও ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। দায়িত্বে কারও গাফিলতি ছিল না।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Tumblr
Telegram

, , বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

যায়যায়কাল এর সর্বশেষ সংবাদ