যায়যায়কাল প্রতিবেদক: ভারতের আদানির বিদ্যুৎ আমদানিতে প্রায় ৪০ কোটি ডলারের শুল্ক ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর; বহুল আলোচিত বিদ্যুৎ কেনার এ চুক্তির সময় সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে পাশ কাটিয়ে শুল্ক ও কর অব্যাহতি দেওয়ার তথ্যও উঠে এসেছে সংস্থাটির তদন্তে।
একই সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিদ্যুৎ প্রবেশ ও সঞ্চালনের সময় আমদানির যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের অংশ হিসেবে কোনো বিল অব এন্ট্রি যেমন দাখিল করা হয়নি, তেমনি তা আইনি পন্থায় নিষ্পত্তি না করার প্রমাণও মিলেছে।
বিদ্যুৎ কেনার আলোচিত এ চুক্তিতে শুল্ক সংক্রান্ত বিষয়গুলো কীভাবে সম্পাদন করা হয়েছে, তাতে কোনো ত্রুটি ছিল কি না, শুল্ক পরিহার বা প্রত্যাহারের বিষয় রয়েছে কি না; এমন আরও কিছু প্রশ্ন সামনে রেখে সম্প্রতি তদন্তে নেমে এসব প্রমাণ পায় এনবিআরের কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই পর্যন্ত ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের বিপরীতে ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৭ ডলারের শুল্ক-কর ‘ফাঁকি’ হয়েছে বলে আট কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি খুঁজে পেয়েছে।
গত ৩ নভেম্বর কমিটির এ প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
২০২৩ সালের ৯ মার্চ ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় স্থাপিত আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ। তখন থেকেই আমদানি করা এ বিদ্যুতের শুল্কসহ অন্যান্য কর পরিশোধ করা হয়নি।
এনবিআরের গোয়েন্দা দল তদন্তে দেখতে পেয়েছে, ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তির আওতায় আদানির কাছ থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বিদ্যুৎ কেনার ক্ষেত্রে শুল্ক ও অব্যাহতি দিয়েছে। তবে এ বিষয়ে এনবিআরসহ যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেয়নি।
এমন প্রেক্ষাপটে কর ‘ফাঁকির’ বিপুল এ অর্থ পিডিবির কাছ থেকে আদায়ের সুপারিশ করেছে এনবিআরের এ কমিটি। এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে চাননি কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের।
তবে শুল্ক ‘ফাঁকির’ বিষয়ে জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান মোঃ রেজাউল করিম বলেন, আমরা এনবিআরের চিঠি পেয়েছি। আমরা এখন বিষদভাবে চুক্তিটি বিশ্লেষণ করছি। কীভাবে এত বড় ফলস হল।
এ অর্থ পিডিবি দেবে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “এখনই তো বলা সম্ভব না। আমরা আগে এটি খতিয়ে দেখি। পরে এটাকে কীভাবে রিজলভ করা যায় তা নিয়ে এনবিআরের সাথে বসব।“
প্রবল আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নেওয়া বিদ্যুৎ খাতের বিভিন্ন চুক্তি নিয়ে সমালোচনা বাড়তে থাকার মধ্যে আদানির বিদ্যুৎ নিয়েও ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
অন্তর্বর্তী সরকার গত ৫ সেপ্টেম্বর বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ এর অধীন সম্পাদিত চুক্তিগুলো পর্যালোচনায় একটি জাতীয় কমিটিও গঠন করেছে।
ভারতের আদানি পাওয়ারসহ বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহ সংক্রান্ত ১১টি চুক্তি খতিয়ে দেখবে বলেও ৩ অক্টোবর জানায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের চুক্তি পর্যালোচনায় গঠন করা এ রিভিউ কমিটি।
এর মধ্যে আদানি পাওয়ারের নির্মিত প্রায় ১৫০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন গোড্ডা পাওয়ার প্লান্টও রয়েছে।
এ নিয়ে আলোচনার মধ্যে বিপুল বকেয়া নিয়ে আদানির সঙ্গে পিডিবির টানাপড়েন চলছে। ৭১ কোটি ডলারের বেশি বকেয়া থাকায় আদানি এক ইউনিট বন্ধ করে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে বলে খবর এসেছে।
এর মধ্যেই এনবিআরের তদন্তে শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া এবং রাজস্ব বোর্ডসহ সংশ্লিষ্টদের অনুমোদন না নিয়ে শুল্ক আহরণ না করার বিষয়টি উঠে এল।
এখন আদানির সঙ্গে হওয়া চুক্তি পরিবর্তন করে শুল্ক যুক্ত হবে কি না এমন প্রশ্নে পিডিবি চেয়ারম্যান রেজাউল করিম বলেন, এটি একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি। এখানে অনেক আইনগত বিষয় আছে। ফলে হুট করে বাতিল বা বদল করা অনেক কঠিন। কী হবে তা পর্যালোচনার পরই বলা যাবে।
কী পেল তদন্ত কমিটি?
চুক্তির আওতায় চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত আদানির কেন্দ্র থেকে ১০৫৮ কোটি ৮৯ লাখ ৯০ হাজার ৮৪ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করেছে বাংলাদেশ; যার মূল্য রয়েছে ১২৮ কোটি ১৮ লাখ ৪৩ হাজার ৪৪২ ডলার।
এর বিপরীতে ৩১ শতাংশ আমদানি শুল্ক ও বিভিন্ন কর মিলে ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৭ ডলারের শুল্ক-কর পাওয়ার কথা এনবিআরের। চুক্তিতে শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া হলেও সেটির অনুমোদন নেওয়া হয়নি এনবিআর থেকে। শুল্ক গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভাষায় এটি ‘ফাঁকি’।
আমদানি করা বিদ্যুতের শুল্ক-কর মওকুফ সংক্রান্ত কোন চুক্তি ছিল কি না এবং থাকলে এ বিষয়ে কোন প্রজ্ঞাপন বা আদেশ জারি হয়েছে কি না জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দাকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড লিখিত জবাব দেয়।
সেখানে বলা হয়, আদানি পাওয়ার (ঝারখণ্ড) লিমিটেড ও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বাস্তবায়ন চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ বিভাগ ২০২২ সালের ১৪ অগাস্ট তৎকালীন এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে আদানির বিদ্যুতের ওপর থেকে প্রযোজ্য যাবতীয় শুল্ক ও কর মওকুফের আবেদন করেন।
এক্ষেত্রে এর আগে ভারতীয় বিদ্যুৎ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এনটিপিসি বিদ্যুৎ নিগম লিমিটেডকে দেওয়া অব্যাহতির কথা তুলে ধরা হয়।
তবে পরে এনবিআরের শুল্ক অব্যাহতি ও প্রকল্প সুবিধা শাখা থেকে অব্যাহতি প্রদানের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি কর আদায়ের এ সংস্থা।
এনবিআরের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, পরে ২০২৩ সালের ১৩ এপ্রিল চুক্তিতে থাকা অব্যাহতির বিষয়ে চুক্তি সম্পাদনের আগে এনবিআরের কোনো মতামত নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চেয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিবকে চিঠি দেওয়া হলেও তিনি জবাব দেনন।
কোন প্রক্রিয়ায় এবং কোন শুল্ক স্টেশন বা হাউজ দিয়ে আদানির বিদ্যুৎ আমদানি হয়েছে তা খোঁজ নিয়েও কমিটি দেখতে পায় এ যাবত ‘কোনো বিল অব এন্ট্রি দাখিল এবং তা আইনানুগ পন্থায় নিষ্পত্তি হয়নি।’
এতে বলা হয়, আদানি থেকে পিডিবি যে রুট (রহনপুর শুল্ক স্টেশন, রাজশাহী) দিয়ে বিদ্যুৎ বাংলাদেশে প্রবেশ ও সঞ্চালন করা হচ্ছে, তা কাস্টমস আইন, ১৯৬৯ বা কাস্টমস আইন, ২০২৩ এর আওতায় ‘কাস্টমস স্টেশন হিসেবে অনুমোদিত বা ঘোষিত স্থান নয়’।
এছাড়া অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম যাচাই করে বিল অব এন্ট্রি দাখিল না করার প্রমাণ পায় এনবিআর।
এমনকি বিদ্যুতের শুল্কায়ন সংক্রান্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করতে এনবিআরের ‘কোন দপ্তরকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়নি’ বলেও এতে তুলে ধরা হয়।
২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর বিদ্যুৎ বিভাগ ও আদানি পাওয়ার এর মধ্যে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি হয়। চুক্তির আওতায় বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দিতে ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে আদানি পাওয়ার।
আদানির বিদ্যুৎ দেশে এনে জাতীয় গ্রিডে যোগ করতে বিশেষ সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশ অংশে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও বগুড়ায় দুটি সাবস্টেশন ও অন্যান্য সঞ্চালন স্থাপনা নির্মাণ করেছে বিদ্যুৎ সঞ্চালন কোম্পানি পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ-পিজিসিবি।
পরে ২০২৩ সালের মার্চে আদানির বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সঞ্চালন শুরু হয়।