শুক্রবার, ৬ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ,২০শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

এর সর্বশেষ সংবাদ

ইশা খাঁর সরাইল: যেখানে শুরু হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতার জাগরণ

পারভেজ আলম আদেল, স্টাফ রিপোর্টার: বাংলার ইতিহাসে অনেক বীরের নাম লেখা আছে সোনার অক্ষরে। কিন্তু যারা একাধারে ছিলেন যোদ্ধা, শাসক, কৌশলী ও দেশপ্রেমিক—তাদের মধ্যে ইশা খাঁ এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার শাসনকেন্দ্র সরাইল আজও দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের এক নিরব সাক্ষী হিসেবে। যেখানে শুরু হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতার প্রথম সুসংগঠিত প্রতিরোধ।

আফগান রক্তে বাংলা প্রেমের সূচনা ইশা খাঁ’র জন্মস্থান নিয়ে মতভেদ থাকলেও অধিকাংশ ইতিহাসবিদ একমত যে তার জন্ম বর্তমান বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল এলাকায়। তিনি ছিলেন আফগান শূর বংশোদ্ভূত। তার পিতা দেওয়ান সুলাইমান খাঁ ছিলেন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।

ইশা খাঁ ছোটবেলা থেকেই কোরআনিক শিক্ষা, ইতিহাস, রাষ্ট্রনীতি এবং অস্ত্রচর্চায় পারদর্শিতা অর্জন করেন, যা তাকে পরিণত করে এক দক্ষ ও দূরদর্শী শাসকে।

পূর্ববাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম ধাপ ১৬শ শতকের মাঝামাঝি সময় ছিল বাংলার জন্য এক উত্তাল অধ্যায়। মুঘল সম্রাট আকবর বাংলায় একচ্ছত্র দখলদারি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও, তা সহজ হয়নি। বাংলার বারো ভূঁইয়া — একদল আঞ্চলিক শাসক — একত্র হয়ে গড়ে তোলেন শক্তিশালী প্রতিরোধ। ইশা খাঁ ছিলেন এই বারো ভূঁইয়ার প্রধানতম নেতা। তার বুদ্ধি, নেতৃত্ব ও সাহসে বারো ভূঁইয়ারা একটি সামরিক ও রাজনৈতিক ফেডারেশনের মতো কাজ করে।

ইশা খাঁ তার রাজধানী ও সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেন সরাইলে। এটি শুধু একটি শাসনকেন্দ্র নয়, ছিল কৌশলগত ও সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। সরাইলের প্রাচীন কেল্লা, মসজিদ, পুকুর ও প্রশাসনিক স্থাপনা আজও তার শাসনের নিদর্শন বহন করে। এখান থেকেই তিনি তার বাহিনী পরিচালনা করেন, যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন এবং পুরো পূর্ববাংলায় প্রভাব বিস্তার করেন।

ইশা খাঁ’র সবচেয়ে স্মরণীয় কৃতিত্ব হলো মুঘলদের বিরুদ্ধে তার ধারাবাহিক প্রতিরোধ। তিনি সোনারগাঁও, ভৈরব, বিক্রমপুর, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা অঞ্চলে বারবার মুঘল বাহিনীকে প্রতিহত করেন। সেনাপতি খান জাহান ও মান সিংহ এর নেতৃত্বে পরিচালিত মুঘল আক্রমণ বারবার তার কৌশল ও দৃঢ়তায় ব্যর্থ হয়।

তিনি শুধু বাহুবলের নয়, বুদ্ধিবলেরও পরিচয় দেন। জলপথে কৌশল, বনে-জঙ্গলে গেরিলা পদ্ধতি, শত্রুপক্ষের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ—সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন এক প্রাজ্ঞ কৌশলবিদ।

ইশা খাঁ ছিলেন একজন ন্যায়নিষ্ঠ শাসক। তার শাসনামলে কৃষির উন্নয়ন, বাণিজ্যের সম্প্রসারণ এবং ধর্মীয় সহনশীলতা ছিল উল্লেখযোগ্য। মুসলিম, হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করত তার শাসিত অঞ্চলে। বিচারব্যবস্থা ছিল সুবিন্যস্ত ও কঠোরভাবে ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত।

ইশা খাঁ’র মৃত্যু হয় ১৫৯৯ সালে। তার মৃত্যুর পর মুঘলরা কিছুটা সফল হয়, কিন্তু তার রেখে যাওয়া চেতনা মুঘলদের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে থেকে যায়। তার সন্তান ও উত্তরসূরিরা কিছু সময় প্রতিরোধ চালিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত মুঘল শাসন বাংলায় প্রতিষ্ঠা পায়।

কিন্তু ইতিহাসে ইশা খাঁ রয়ে যান বাংলার স্বাধীনতাকামী আত্মার প্রথম জাগরণ হিসেবে। তার ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্ব, বীরত্ব ও কৌশলী দূরদর্শিতা তাকে পরিণত করেছে এক ঐতিহাসিক কিংবদন্তীতে।

সরাইল কেবল একটি ভূগোল নয়; এটি একটি প্রতীক—স্বাধীনতার, আত্মমর্যাদার, প্রতিরোধের। এখানেই জন্ম নিয়েছিলেন সেই বীর, যিনি মাটি ও মানুষের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। আজও সরাইলের বাতাসে, কেল্লার ইটে, নদীর প্রবাহে, ইতিহাসের পাতায়—জ্বলজ্বল করে ইশা খাঁ’র নাম।

বাংলার প্রতিটি স্বাধীনতাকামী হৃদয়ে আজও ধ্বনিত হয় সেই ডাক— “জেগে ওঠো ইশা খাঁর মত, যদি হারাতে না চাও নিজের পরিচয়।”

ইশা খাঁ — বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের এক উজ্জ্বল নাম। সরাইলের এই বীর সন্তানের জন্মভূমি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তা সংরক্ষণ করতে সরাইলের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বহুদিন ধরে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রশাসনিক সঠিক উদ্যোগের অভাবে তাদের প্রচেষ্টা আজও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য লাভ করতে পারেনি।

ইশা খা — বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের এক উজ্জ্বল নাম। সরাইলের এই বীর সন্তানের জন্মভূমি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তা সংরক্ষণ করতে সরাইলের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বহুদিন ধরে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রশাসনিক সঠিক উদ্যোগের অভাবে তাদের প্রচেষ্টা আজও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য লাভ করতে পারেনি।

সরাইল সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মৃধা আহমেদুল কামাল ও বিশিষ্ট সমাজকর্মী রওশন আলী জানান, এই লক্ষ্যে জনাব শাহজাহান ঠাকুরের নেতৃত্বে “ইশা খা পরিষদ” নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ব্যক্তি উদ্যোগে সংগঠনটির জন্য একটি ফান্ড গঠন করা হয়। সংগঠনটির মূল উদ্দেশ্য ছিল ইশা খার জন্মভূমির ইতিহাস সংরক্ষণ এবং দেশ-বিদেশে তা সঠিকভাবে তুলে ধরা। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে, সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার মাত্র ১৫ দিনের মাথায় শাহজাহান ঠাকুরের মৃত্যু হলে এর কার্যক্রম কার্যত স্থগিত হয়ে পড়ে।

অযত্নে ও অবহেলায় পড়ে থাকা সেই স্বর্ণালী ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নিরলস গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন সরাইল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক তৌফিক আহমেদ তফছির।

তিনি মনে করেন, “এই গৌরবময় ইতিহাসকে সংরক্ষণ করা শুধু সরকারের নয়, বরং আমাদের সবার একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক দায়িত্ব।”

এই প্রেক্ষাপটে ইতিহাসপ্রেমী, গবেষক ও সচেতন মহল মনে করেন, সরকারি সহযোগিতা ও প্রশাসনিক সদিচ্ছা থাকলে ইশা খার স্মৃতি বিজড়িত সরাইলকে একটি ঐতিহাসিক ও পর্যটন সম্ভাবনাময় কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। একইসাথে, ইশা খার ইতিহাসের সংরক্ষণ ও প্রচারের মধ্য দিয়ে দেশের গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে নতুন প্রজন্মের সামনে উপস্থাপন করা যাবে।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Tumblr
Telegram

বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *