
যায়যায় কাল প্রতিবেদক : সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের ‘জাতীয় শোক দিবস’এর ছুটি বাতিল ও বিরোধী পক্ষের সম্ভাব্য বাধার মুখে ভিন্ন এক বাস্তবতায় ১৫ আগস্ট পালনে প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে।
দলটির নেতারা আত্মগোপনে, ভারতে অবস্থানকারী সভাপতি শেখ হাসিনা নেতাকর্মীদেরকে দিবসটি পালনে আহ্বান জানিয়েছেন, নেতাকর্মীরা সামাজিক মাধ্যমে ধানমন্ডি ৩২ অভিমুখে যাত্রার ঘোষণা দিয়েছেন, আবার গণ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠনগুলো রাজপথে সক্রিয়, সব মিলিয়ে এক ধরনের উত্তেজনা রয়েছে দিবসটি ঘিরে।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সেনাবাহিনীর একদল কর্মকর্তা ও সৈনিকের হাতে সপরিবারে প্রাণ দেওয়া জাতির পিতার স্মরণে আয়োজনে ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর এমন বাস্তবতা দেখেনি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দলটি।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রায় সব ভাস্কর্য, ম্যুরাল আক্রান্ত হয়, পুড়িয়ে দেওয়া হয় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে তার বাসভবনে স্থাপন করা স্মৃতি জাদুঘরও। আগুন দেওয়া হয় শহীদ বেদীতেও। সেই পুড়িয়ে দেওয়া ভবনকে ঘিরে মিছিলের ডাক দেওয়া হয়েছে দলের পক্ষ থেকে।
আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানব সম্পদ বিষয়ক সম্পাদক সামসুন্নাহার চাঁপা বলেন, শেখ হাসিনার নির্দেশে নেতাকর্মীরা ১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে যাবে।
কৃষি ও সমবায় বিষয়ক উপকমিটির সদস্য মো. জাবের হোসেন লিখনসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা ফেইসবুক পোস্টে স্টিকার শেয়ার করেছেন। সেখানে লেখা, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। মার্চ টু ধানমন্ডি ৩২। দলে দলে যোগ দিন সফল করুন।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের উপ দপ্তর সম্পাদক আরিফুর রহমান রাসেল বলেন, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমন্বয় রেখে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে ১৫ আগস্ট পালন করবে।
কর্মসূচি সম্পর্কে তিনি বলেন, সকাল ৮টায় বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, সাড়ে আটটটায় বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে মিলাদ মাহফিল, সকাল ৯ টায় ধানমন্ডি ৩২ থেকে কলাবাগান মাঠ হয়ে আবার ধানমন্ডি ৩২ পর্যন্ত শোক মিছিল এবং ১০টায় বনানী কবরস্থানে ১৫ অগস্টে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর দিনটিকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করা শুরু করে। ২০০২ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ১৫ আগস্টের ছুটি বাতিল করে। পরে ২০০৮ সালে সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে উচ্চ আদালতের আদেশে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন শুরু হয়। রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনের পাশাপাশি ঘোষণা হয় সরকারি ছুটিও।
পাশাপাশি আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনও নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে দিনটিতে।
মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম বৈঠকেই ১৫ আগস্টের জাতীয় শোক দিবসের সাধারণ ছুটি বাতিল করা হয়।
সেদিনই ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে ভাবগম্ভীর পরিবেশে জাতীয় শোক দিবস ১৫ আগস্ট পালন করার আহ্বান জানান।
ভারতে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগ সভাপতির ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ফেইসবুক পেজে এই বিবৃতি পোস্ট করা হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু ভবনে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও দোয়া মোনাজাত করে সকলের আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বাংলাদেশের মানুষের মঙ্গল করুন।
সরকার পতনের আঁচ সেভাবে না পড়া বঙ্গবন্ধুর নিজের জেলা গোপালগঞ্জে অবশ্য বাধাহীনভাবেই নানা আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন রাখা হয়েছে।
কালো ব্যাজ ধারণ, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে সকালে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, দোয়া ও মোনাজাত, আলোচনা সভা এবং দরিদ্রদের মাঝে খাবার বিতরণের মত কর্মসূচি রয়েছে সেখানে।
গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিএম শাহবুদ্দির আজম বলেন, এ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে না পারলে নেতাকর্মীদের লংমার্চ করে ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে যাওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ শাসনামলে প্রতি বছর সকাল সাড়ে ৬টায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতেন। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা এ সময় দেন গার্ড অব অনার। তবে এবার তা আর হচ্ছে না।
প্রায় ৪৮ বছর আগে এই বঙ্গবন্ধু ভবনেই ঘাতকরা হানা দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও তার স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসেরকে হত্যা করে।
সেই রাতেই নিহত হন বঙ্গবন্ধুর বোনের স্বামী আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবী ও শিশুপৌত্র সুকান্ত বাবু; বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, নিকটাত্মীয় শহীদ সেরনিয়াবাত ও রিন্টু।
ধানমন্ডির বাড়িতে পুলিশের বিশেষ শাখার সাব ইন্সপেক্টর সিদ্দিকুর রহমান ও বঙ্গবন্ধু ভবনের অদূরে নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলকেও গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় সে সময় প্রাণে বেঁচে যান।
বঙ্গবন্ধুকে জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় দাফন করা হলেও পরিবারের অন্য সদস্যদের ঢাকার বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্রলীগ গঠনের মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনায় আসেন তিনি।
এরপর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন ও ১৯৬৬ সালের ছয় দফা প্রণয়ন, ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি শেখ মুজিব বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন।
১৯৬৯ এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কারামুক্ত হন তিনি। এরপর তাকে বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিত করে ছাত্র-জনতা। ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) স্বাধীনতার ডাক দেন তিনি।
তার নেতৃত্বে রক্তাক্ত সংগ্রামেই অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের। আর স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় নির্মমভাবে প্রাণ হারাতে হয় বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরও আওয়ামী লীগকে যেতে হয় কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে। এমনকি এই হত্যার বিচারের সুযোগও বন্ধ করে দেওয়া হয় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান এই অর্ডিন্যান্সকে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এই অধ্যাদেশ বাতিল করে বিচার শুরু হয়। তবে ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনে হেরে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে চলে যাওয়ার পর দণ্ড কার্যকর হয়নি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর মামলার বিচার চূড়ান্তভাবে শেষ করার পর ২০১০ সালে পাঁচ খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তবে দণ্ডিত ছয় খুনি এখনও বিভিন্ন দেশে পালিয়ে আছেন।
১৪ দলে আওয়ামী লীগের শরিক জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার ১৫ আগস্টকে সামনে রেখে একটি বিবৃতি দিয়েছেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টকে আধুনিক বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় উল্লেখ করে এতে বলা হয়, “ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবন ও বঙ্গবন্ধু জাদুঘর শুধু বঙ্গবন্ধুর বাড়ি নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস।
সুতরাং সেই ইতিহাস আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ও ম্যুরাল গুঁড়িয়ে দিয়ে বাঙালির হৃদয়ের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার আসন থেকে বঙ্গবন্ধুকে ম্লান করা যাবে না।












