মঙ্গলবার, ১৭ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ,১লা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

এর সর্বশেষ সংবাদ

দুবাইয়ে ধনীদের গোপন সম্পদের পাহাড়

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : দুবাইয়ে গোপনে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা। বিলাসবহুল বিচ ক্লাব, বড় বড় শপিং মল, অত্যাধুনিক অট্টালিকার জন্য সুপরিচিত এই শহরে একেকজন ধনকুবের লাখো ডলার মূল্যের সম্পদের মালিক হয়েছে। সম্প্রতি একটি বৈশ্বিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা প্রকল্প ‘অরগ্যানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট’ (ওসিসিআরপি) দুবাইয়ের বড় বড় অট্টালিকা ও অন্যান্য সম্পত্তির মালিকদের নিয়ে ‘দুবাই আনলকড’ নামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য।

প্রতিবেদনে জানা গেছে দুবাইয়ে গোপনে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা। বিলাসবহুল বিচ ক্লাব, বড় বড় শপিং মল, অত্যাধুনিক অট্টালিকার জন্য সুপরিচিত এই শহরে একেকজন ধনকুবের লাখো ডলার মূল্যের সম্পদের মালিক হয়েছে। এ তালিকায় রয়েছেন বড় ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞায় থাকা ব্যক্তি, এমনকি অর্থ পাচারকারী ও অপরাধীরাও।

‘দুবাই আনলকড’ প্রকল্পের সমন্বয় করেছে ওসিসিআরপি ও নরওয়ের সংবাদমাধ্যম ই-টোয়েন্টিফোর। এ প্রকল্পে অংশ নিয়েছে ৫৮টি দেশের ৭৫টি সংবাদমাধ্যম। প্রতিবেদনটি ওসিসিআরপির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রকল্পের প্রতিবেদন মতে, শিথিল নীতিমালার কারণে দুবাইয়ের আবাসন খাত অপরাধী, পলাতক আসামি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় থাকা ব্যক্তিদের আকর্ষণ করতে সফল হয়েছে। বস্তুত, অবৈধ অর্থ লুকিয়ে রাখার জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে দুবাই।

এই প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে, কারা মধ্যপ্রাচ্যের আর্থিক লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করেন এবং কীভাবে সারা বিশ্বে অপরাধীর তকমা পাওয়া হাজারো মানুষকে নানা সুবিধা দিয়েছে দুবাই। বেশ কয়েক বছর ধরে দুবাই অবৈধ অর্থ পাচারের জনপ্রিয় গন্তব্য হিসেবে পরিচিত, বিশেষত আবাসন খাতের মাধ্যমে।

এর আগেও দুবাইকে ঘিরে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে—কিন্তু সেসব প্রতিবেদনে কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল বা দেশের ওপর নজর দেওয়া হয়েছে। এবারই প্রথমবারের মতো ‘দুবাই আনলকড’ প্রকল্পে বিশ্বের প্রতিটি দেশে নজর দেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, যারা পশ্চিমা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা বা বিধিনিষেধের আওতা থেকে বাঁচতে চান, তাদের কাছে দুবাই খুবই জনপ্রিয়। এর পেছনে মূল কারণ হলো, বেশিরভাগ দেশের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতের অপরাধী বিনিময়ের চুক্তি নেই। এ কারণে অন্যান্য দেশের পলাতক আসামিরা নির্ভয়ে দুবাইয়ে আশ্রয় নেন। এ ধরনের চুক্তির অভাবে বিদেশি রাষ্ট্রের অনুরোধে কাউকে গ্রেপ্তার বা সম্পত্তি জব্দ করার ঘটনা দুবাইতে খুবই বিরল।

দুবাইয়ের আবাসন খাতের এজেন্টরাও তাদের ক্রেতাদের অর্থের উৎস নিয়ে তেমন মাথা ঘামান না। ২০২২ সালের আগে পর্যন্ত বড় আকারে নগদ অর্থ বা ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেন বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে তথ্য দেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না তাদের। এ ছাড়া, দুবাইয়ের আবাসন খাত বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক আবাসন খাতের মধ্যে অন্যতম। যার ফলে এখানে বিনিয়োগের সুযোগের অভাব নেই বললেই চলে। দুবাইয়ে আবাসনের মূল্য দিন দিন বাড়ছে আর এজেন্টরা সব সময়ই অবৈধ অর্থকে বৈধ করার নতুন নতুন উপায় খুঁজে বের করছেন। যার ফলে তারা বাড়তি মুনাফার মুখও দেখেন।

দুবাইয়ের ভূমি অধিদপ্তরসহ কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের ফাঁস হওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এ অনুসন্ধান চালানো হয়। এতে ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দুবাইয়ে এসব ব্যক্তির মালিকানায় থাকা ও ব্যবহার করা সম্পদের বিস্তারিত চিত্র উঠে এসেছে। ফাঁস হওয়া তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে ওয়াশিংটনভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজ (সিফোরএডিএস)। প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ও সংঘাত নিয়ে গবেষণা করে। পরে এসব তথ্য-উপাত্ত ই-টোয়েন্টিফোর এবং ওসিসিআরপির হাতে আসে। এই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সংবাদমাধ্যম ফোর্বস।

কয়েক মাস ধরে দুবাইয়ের হাজারো ভূমি নিবন্ধন নথি খুঁটিয়ে দেখেন পত্রিকাটির সাংবাদিকরা। বিশ্বের কোন কোন ধনী ব্যক্তি দুবাইয়ে সম্পদের মালিক এবং সেখানে তাদের কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, সেসব জানার চেষ্টা করেছেন তারা।

প্রতিটি সম্পত্তির মূল মালিকের নাম, তাদের জন্ম তারিখ, পাসপোর্ট নম্বর ও জাতীয়তার তথ্য রয়েছে এতে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মালিকের বদলে যারা এসব সম্পত্তি ভাড়া নিয়েছেন, তাদের বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া গেছে। প্রতিবেদন মতে, ২০২২ সালে দুবাইয়ের আবাসন খাতে বিদেশিদের অবদান ১৬ হাজার কোটি ডলার।

ওসিসিআরপির প্রতিবেদনে ২০০ ব্যক্তির দিকে আলাদা নজর দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে আছেন অভিযুক্ত অপরাধী, পলাতক আসামি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা মানুষ। তারা সম্মিলিতভাবে দুবাইয়ে এক হাজারেরও বেশি সম্পত্তির মালিক।

সাংবাদিকরা ফাঁস হওয়া তথ্যে উল্লেখিত মানুষদের পরিচয় যাচাই করার জন্য বেশ কয়েক মাস সময় নেন। পাশাপাশি, তারা আসলেই এসব সম্পত্তির মালিক কি না, সেটাও আনুষ্ঠানিক নথি, ওপেন সোর্স গবেষণা ও অন্যান্য ফাঁস হওয়া তথ্যের মাধ্যমে যাচাই করা হয়। শুধু যাদের পরিচয় ও মালিকানা স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়েছে, তাদের তথ্যই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

২০২২ সালের মার্চে ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ) নামে একটি আন্তর্জাতিক অর্থপাচার বিরোধী সংগঠন উল্লেখ করে, অর্থ পাচার রোধ ও জঙ্গিদের অর্থায়ন দমনে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ‘সীমাবদ্ধতা’ রয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক মহলে দেশটির সুনামহানি হয়।

মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনৈতিক কেন্দ্রে হিসেবে পরিচিত দুবাইয়ের সুনাম পুনরুদ্ধারে দেশটির কর্তৃপক্ষ আরও কঠোর আইন প্রণয়ন করে এবং বিদেশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা চায়। আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সন্দেহজনক লেনদেন বিষয়ে আবাসন খাতের এজেন্ট, ব্রোকার ও করপোরেট সেবাদাতারা এখন আগের চেয়ে নজরদারি অনেক বাড়িয়েছেন। ২০২২ সালের পর থেকে এ ধরনের লেনদেনের বিপরীতে জরিমানা আদায়ের পরিমাণ তিন গুণ বেড়েছে। তবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কর্তৃপক্ষের নজরে আসা সন্দেহজনক লেনদেনের সংখ্যা মোট লেনদেনের তুলনায় এখনো অনেক কম।

এই প্রকল্প ও প্রতিবেদন বিষয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কর্মকর্তারা কোনো প্রশ্নের বিস্তারিত জবাব দেননি। স্বরাষ্ট্র, অর্থ ও আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের এসব প্রশ্ন করা হয়। তবে যুক্তরাজ্য ও নরওয়েতে নিযুক্ত সংযুক্ত আরব আমিরাত দূতাবাস থেকে সাংবাদিকদের সংক্ষিপ্ত জবাব দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, সংযুক্ত আরব আমিরাত ‘আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থার ভারসাম্য রক্ষায় তাদের ভূমিকাকে খুবই গুরুত্ব সহকারে দেখে’।

ওসিসিআরপি ও ই-টোয়েন্টিফোরের পাশাপাশি ৭৫টি গণমাধ্যমের সাংবাদিক এই প্রকল্পে কাজ করেছেন। উল্লেখযোগ্য সংবাদমাধ্যমের মধ্যে রয়েছে আলজাজিরা, ডন, ফোর্বস, স্ট্রেইটস টাইমস, আফ্রিকা আনসেনসরড, সিডনি মর্নিং হেরাল্ড, দ্য নিক্কেই, অস্ত্রো ও বেলারুশিয়ান ইনভেস্টিগেটিভ সেন্টার।ওসিসিআরপির ওয়েবসাইটে দেওয়া তালিকা অনুযায়ী, ৬২ দেশের ১৭১ জনের নাম রয়েছে, যারা নিষেধাজ্ঞায় রয়েছেন, অর্থ পাচার করেছেন, অপরাধী কিংবা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের নাম রয়েছে তালিকায়। এর মধ্যে ভারতের চারজন, পাকিস্তানের চারজন এবং আফগানিস্তানের ১০ জনের নাম রয়েছে যারা রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, নিষেধাজ্ঞার আওতায় আছেন কিংবা অপরাধী।

ভারতের চারজন হচ্ছেন—জাসমিত হাকিমজাদা, নিরব মোদি, শাহুল হামিদ দাউদ ও বিনোদ আদানি। পাকিস্তানের চারজনের মধ্যে রয়েছে দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি ও তার পরিবার এবং পারভেজ মোশাররফের নাম। দুবাইয়ে সবচেয়ে দামী সম্পদের মালিকদের নিয়ে একটি তালিকা তৈরি করেছে ফোর্বস। সেখানে ১০ জন ধনকুবেরের নাম, তাদের নিট সম্পদ ও দুবাইয়ে থাকা সম্পদের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। তালিকার শুরুতেই রয়েছে ভারতীয় নাগরিক মুকেশ আম্বানির নাম।

এ ছাড়া রয়েছে ভারতীয় নাগরিক এম এ ইউসুফ আলী ও শামশীর ভায়ালিল, ওমানের নাগরিক সুহাইল বাহওয়ান, রাশিয়ার নাগরিক আন্দ্রেই মোলচানভ, সাইপ্রাসের নাগরিক বিনোদ আদানি (ওসিসিআরপির ওয়েবসাইটে বিনোদ আদানিকে ভারতীয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে), কানাডার নাগরিক চ্যাংপেং ঝাও, যুক্তরাজ্যের নাগরিক সকেট বর্মনের, সাইপ্রাসের নাগরিক ইগর মাকারভ এবং মিশরের নাগরিক নগিব সাবিরিস।

তালিকায় দারিদ্র্যপীড়িত ও যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের অন্তত সাত নাগরিকের নামও রয়েছে। পাকিস্তানের গণমাধ্যম ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফাঁস হওয়া নথি অনুযায়ী দুবাইয়ে ১৭ হাজার পাকিস্তানি সম্পদের মালিক। তবে বাস্তবে এই সংখ্যা ২২ হাজারের মতো বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

এ ছাড়া, তালিকায় চীন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের নাগরিকদের নাম যেমন রয়েছে, তেমন নাম রয়েছে ইয়েমেন, নাইজেরিয়া ও কেনিয়ার মতো দেশের নাগরিকদেরও। আরও রয়েছে নিষেধাজ্ঞার অধীনে থাকা মিয়ানমারের একজন অস্ত্র ব্যবসায়ীর নামও।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Tumblr
Telegram

বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

যায়যায়কাল এর সর্বশেষ সংবাদ