বৃহস্পতিবার, ১৬ই শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ,৩১শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

এর সর্বশেষ সংবাদ

মাদক ও অনলাইন জুয়ার ফাঁদে সরাইলের যুব সমাজ

পারভেজ আলম আদেল, স্টাফ রিপোর্টার: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায় দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে মাদক ও অনলাইন জুয়ার বিস্তার। কিশোর ও তরুণরা নেশার জগতে ঢুকে পড়ছে অল্প বয়সেই। তাদের হাতে বই-খাতার বদলে এখন মোবাইল ফোন, যার একপাশে মাদক, অন্যপাশে অনলাইন জুয়া। এই দুই নেশার মরণছোবলে ধ্বংসের পথে হাঁটছে সম্ভাবনাময় এক প্রজন্ম। আর এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন উপজেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, সমাজকর্মী ও অভিভাবকেরা।

সরাইলের হাটবাজার, চা-স্টল, বাসস্ট্যান্ড ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আশপাশে এখন ইয়াবা, গাঁজা ও ফেনসিডিলের অবাধ সেবন ও কেনাবেচা চলছে। কেউ কেউ স্কুল ফাঁকি দিয়ে এসব মাদক সেবনের জন্য নির্জন স্থানে জড়ো হচ্ছে। অভিভাবকরা বলছেন, ছেলেরা রাতে ঘরে থাকে না, টাকা হারিয়ে যায়, আর আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা যাচ্ছে।

এ বিষয়ে সরাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, “মাদকের বিরুদ্ধে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। অনেক মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীকে আটক করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তবে শুধু পুলিশের অভিযান যথেষ্ট নয়, পরিবার ও সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। সবাইকে নিয়ে আমরা চাই একটি মাদকমুক্ত সরাইল গড়ে তুলতে।”

এদিকে, মাদক ছাড়াও সরাইলের যুবসমাজকে গ্রাস করছে আরেকটি বিপজ্জনক আসক্তি অনলাইন জুয়া। মোবাইল ফোনে ইনস্টল করা বিভিন্ন অ্যাপ যেমন স্পিন, বেটিং, লাকি ড্র-এর মাধ্যমে চলছে ভার্চুয়াল জুয়ার ভয়াবহ বিস্তার। প্রথমে খেলাচ্ছলে শুরু হলেও ধীরে ধীরে মোবাইল বিক্রি, পরিবারের টাকা চুরি এবং ঋণের দায়ে পড়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে অনেক তরুণ।

এই বিষয়ে সরাইল সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল জব্বার বলেন, “অনলাইন জুয়া এখন গ্রামেও পৌঁছে গেছে। ছাত্ররা ক্লাসে না গিয়ে মোবাইলে জুয়া খেলছে। আমরা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু এ সমস্যার সমাধানে পরিবার ও অভিভাবকদের সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে হবে।”

এ বিষয়ে মতামত দিতে গিয়ে সমাজকর্মী রওশন আলী বলেন, “আমরা দেখছি, কিশোর ও তরুণদের মধ্যে মানসিক অবসাদ, আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই অনেকেই মাদকের আশ্রয় নিচ্ছে। অনলাইন জুয়া যেন এখন এক ধরনের ডিজিটাল নেশায় পরিণত হয়েছে। এটি কেবল আইনশৃঙ্খলার বিষয় নয়, এটি একটি সামগ্রিক সামাজিক ব্যাধি। পরিবার, স্কুল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন একসঙ্গে কাজ না করলে এর ভয়াবহতা আরও বাড়বে।”

উপজেলা প্রশাসনও বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। সরাইল উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোশারফ হোসেন বলেন, “মাদক ও অনলাইন জুয়া প্রতিরোধে আমাদের জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে। নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। পাশাপাশি স্কুল-কলেজে সচেতনতামূলক সভা ও ক্যাম্পেইন চালানো হচ্ছে। আমরা চাই সবাই শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, ধর্মীয় নেতা ও অভিভাবকরা যেন একসঙ্গে এই ব্যাধির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।”

তিনি আরও বলেন, “তরুণদের বিকল্প বিনোদন ও শিক্ষামূলক কার্যক্রমে যুক্ত করতে হবে। কেবল শাস্তি দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সচেতনতা, সহমর্মিতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণই পারে তাদের সঠিক পথে ফেরাতে।”

সরাইলের এ সংকটময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে চাই সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন। প্রশাসন, পরিবার ও সমাজের সব স্তরের সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া এই ভয়াবহ পরিস্থিতি রোধ সম্ভব নয়। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে সরাইলের সম্ভাবনাময় প্রজন্ম অন্ধকারে হারিয়ে যাবে যার ক্ষতি হবে স্থায়ী ও বিপর্যয়কর।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Tumblr
Telegram

বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *