মঙ্গলবার, ১৭ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ,১লা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

রসের হাঁড়িতে নিপাহ দিচ্ছে উঁকি, বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি

শাহ্ সোহানুর রহমান, রাজশাহী: রাজশাহীতে যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে খেজুরের কাঁচা রস। শখ করে কাঁচা খেঁজুর রস পানে মৃত্যুও হচ্ছে। এসব রস ঢাকাসহ পাঠানো হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। স্থানীয় গাছিরাও মৃত্যুঝুঁকির কথা স্বীকার করছেন। তবু তারা স্বাস্থ্যসম্মতভাবে রস সংগ্রহ করছেন না। জনসাধারণও কাঁচা রস পান থেকে বিরত হচ্ছেন না। এতে মরণঘাতি নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কার মুখে হাজারও মানুষ। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে লিটল আলী নামে নওগাঁর মহাদেবপুরের এক তরুণ নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ২৪ জানুয়ারি এ ভাইরাসে মারা যায় মো. সোয়াদ নামে পাবনার ঈশ্বরদীর এক শিশু। গত বছরের জানুয়ারিতে আফজাল হোসেন নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। তার বাড়ি বাঘা উপজেলায়। তারা প্রত্যেকেই কাঁচা খেঁজুর রস পান করেছিলেন।আইইডিসিআর সম্প্রতি জানিয়েছে, গত বছর নিপাহ ভাইরাসে চার জেলায় (খুলনা, শরীয়তপুর, মানিকগঞ্জ ও নওগাঁ) পাঁচজন আক্রান্ত হন। পরে ওই পাঁচজনই মারা গেছেন। এ নিয়ে দেশে ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩৪৩ জন আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন, এর মধ্যে ৭১ শতাংশই মারা গেছেন।
গাছিরা বলছেন, লাভজনক হওয়ায় তারা বিভিন্নভাবে রস বিক্রি করেন। গুড় তৈরির পাশাপাশি কাঁচা রসও বিক্রি করে থাকেন তারা। ৪০ বছর ধরে রস বিক্রি করছেন জেলার চারঘাটের মেরামতপুর এলাকার আতাউর রহমান। তিনি বলেন, আমার বয়স যখন ৫ বছর, তখন থেকেই আব্বার সাথে রস সংগ্রহ করে বিক্রি করে আসছি। বর্তমানে আমার ৮০টা খেজুর গাছ। দৈনিক এক মণের জারকিনে ৬ জারকিন রস হয়। বেশিরভাগ রসের গুড় বানাই। বাকি রস বিক্রি করি।
তিনি আরও বলেন, আগে অনেক বাদুড় দেখতাম, এখন কম। কিন্তু পাখি বসে। বিকাল বা সাঁঝের বেলা (সন্ধ্যা) পাখি বেশি বসে।
আফজালের ভাই মো. বাবুল হোসেন বলেন, আমার ভাই শখ করে কাঁচা রস পান করে অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করি। পরে অবস্থার অবনতি হয়ে তিনি মারা যান। আমরাও মাঝেমধ্যে রস পান করি। তবে তার অবস্থাটা জটিল হয়ে যাওয়ায় বাঁচানো যায়নি।
এছাড়া গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জেলার দুর্গাপুরের একই পরিবারের দুই বোনের মৃত্যু হয়। নিপাহ উপসর্গে তাদের মৃত্যু হয়। যদিও নিপাহ সংক্রমণ হয়নি বলে পরবর্তীতে আইইডিসিআর থেকে জানানো হয়।কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, জেলায় মোট ৫৪৩ হেক্টর জমিতে খেজুর গাছ রয়েছে ১১ লাখ ৮ হাজার ১৮টি। জেলার বাঘা, চারঘাট, পুঠিয়া ও দুর্গাপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি খেজুরের গাছ রয়েছে। এসব গাছ থেকে খেঁজুর রস ও গুড় উৎপাদন ও বিক্রি করে প্রায় ২৮ হাজার পরিবার জীবিকা নির্বাহ করে। এতে গ্রামীণ বাসিন্দারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলেও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।
বিষয়টি গাছিরাও অবগত। তবে উদাসীনতার কারণে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।জেলার বাঘা ও চারঘাট থেকে বাসে বিশেষ কায়দায় রাজধানী ঢাকায় খেজুর রস পাঠানো হচ্ছে। এসব রস নেশা হিসেবে তৈরি করে পান করছেন মাদকসেবীরা। এছাড়া পুঠিয়া ও দুর্গাপুরের কয়েকটি স্পটে মাদকের আসরে কাঁচা রস নেশা হিসেবে পান করা হয়। রস পঁচিয়ে নেশাদ্রব্য তৈরি করা হয়। স্থানীয় ভাষায় এটি ‘তাড়ি’ হিসেবে পরিচিত।
বাঘার গাছি আশিকুর রহমান বলেন, আমার ৯০টি গাছ আছে। ভোর ৪টা থেকে রস সংগ্রহ শুরু করি, এক ঘণ্টায় সংগ্রহ হয়ে যায়। মাটির হাড়িতে শুধু চুন দেই। হাড়িতে নেট দেওয়া হয় না। রসের হাড়িতে পাখি লাগে এটা সত্য; বাদুড়ও লাগতে দেখি, তবে আগের তুলনায় কম। প্রতিদিন আমি ২৪ কেজি রস বিক্রি করি। এসব রস ঢাকায় পাঠানো হয়। বাকি রস দিয়ে গুড় বানিয়ে বিক্রি করি। এই এলাকার প্রায় এক হাজার গাছি ১০ হাজার খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ ও বিক্রি করেন।
চারঘাটে রসের ব্যবসা করে সংসার চালাচ্ছেন মো. মুছা নামে এক কৃষক। তিনি বলেন, আমার ৪০টি গাছে দৈনিক ৭০ লিটার রস হয়। প্রতি লিটার কাঁচা রস ৪০ টাকা দরে বিক্রি করি। পাখি-টাখি বসে তো, বাদুড় বসে। হাড়ি নেট দিয়ে ঢাকা হয় না। নিজস্ব কেউ নিতে চাইলে আগে থেকে বললে তখন গাছে নেট দিয়ে হাড়ি ঢেকে রাখি, তাছাড়া না।
বিশেষ কায়দায় এসব রস নিয়মিত ঢাকায় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করছেন মিজানুর রহমান নামে এক যুবক। বাঘা ও চারঘাট থেকে এসব রস সংগ্রহ করেন তিনি। বাসযোগে নিয়ে যেতে যেতে রস নষ্ট হয়ে গেলেও তিনি সুকৌশলে বিক্রি করছেন। এসব রস থেকে তৈরি করা হয় নেশা। মিজানুর রহমান বলেন, ঢাকায় ১০০ টাকা লিটার বিক্রি করছি। দৈনিক আমার কাছে ৪০-৫০ লিটারের অর্ডার আসে। আমি নিজেই গ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসি। স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রস তো ভাল থাকে। আমি বরফ দিয়ে নিয়ে আসি, নষ্ট হয় না।তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ২০০১ সালে মেহেরপুরে প্রথম নিপাহ ভাইরাস রোগী শনাক্ত হলেও এখনও এটির কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি। ইতোমধ্যে প্রায় ৩৪ জেলায় ভাইরাসটি শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া মৃত্যুহার ৭১ শতাংশ। ফলে প্রতিরোধই এই ভাইরাস থেকে একমাত্র বাঁচার উপায়। তারা বলেন, খেজুর রসে বাদুড়ের লালা থেকে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ হয়। কোনো অবস্থাতেই খেজুরের কাঁচা রস পান করা যাবে না।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. জাফরুল হক বলেন, আমাদের লিফলেট বিতরণ চলছে। নিপাহ ভাইরাস নিয়ে মানুষ সচেতন হয়েছে, আরও সচেতন হতে হবে। কাঁচা রস পান থেকে বিরত থাকতে হবে। যেসব হাঁড়ি বসানো হয়, ওগুলোতে প্রটেকশন দিলে ভাল হয়। আমাদের সেন্ট্রাল থেকে নির্দেশনা আছে, আমরা কাজ করছি।
ভাইরোলজির নিপাহ সারভাইলেন্স নিয়ে কাজ করছেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) বৈজ্ঞানিক অফিসার ডা. শারমিন সুলতানা। তিনি বলেন, সাধারণত ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাসের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। এ বছর এখনও আমরা নিপাহ সংক্রমিত কাউকে পাইনি। তবে ভাইরাসটি নিয়ে আমরা রেগুলার কাজ করছি। ডিসেম্বরের আগেই প্রোগ্রাম করেছি।
ডা. শারমিন সুলতানা বলেন, ভুল করেও খেজুরের কাঁচা রস পান করা যাবে না। কারও পছন্দ হলে যেন অবশ্যই ফুটিয়ে পান করে, কাঁচা কেউ পান করবেন না। ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফুটিয়ে পান করতে পারেন। আমরা স্কুলগুলোতে বাচ্চাদেরকে গিয়ে বলছি, তোমরা কেউ খাবা না। রাজশাহী ও রাজবাড়িতে গত বছর প্রোগ্রাম হয়েছে। সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা করছি। সরকারের নজরেও দিচ্ছি। এসব বিষয় আমরা পলিসি মেকারদের ইনফর্ম করি।
আইইডিসিআরের এই বৈজ্ঞানিক অফিসার আরও বলেন, নিপাহ প্রতিরোধে সবারই ভূমিকা রাখা উচিত। কাঁচা রস পান করার পর নিপাহ ভাইরাস সংক্রমিত হয়, এটা সবাই জানে; কিন্তু মানতে চায় না। আসলে বিহেভিয়ারাল চেঞ্জ না আসলে হবে না। সবাইকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে।
Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Tumblr
Telegram

বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

যায়যায়কাল এর সর্বশেষ সংবাদ