নিজস্ব প্রতিবেদক:লন্ডনে আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক সিম্পোজিয়ামে বক্তারা বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সংঘটিত জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন।
ইউরোপ প্রবাসী বাংলাদেশীদের সংগঠন ইউরোপীয় বাংলাদেশ ফোরাম (ইবিএফ) গতকাল মঙ্গলবার লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব অরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজের সেমিনার কক্ষে এ সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করে। ইবিএফ-এর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আজ একথা জানানো হয়।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মী এবং জেনোসাইড বিশেষজ্ঞগণ ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিলসমূহ পর্যালোচনা এবং বিশ্লেষণ করে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসরদের সংঘটিত নারকীয় জেনোসাইডের অনতিবিলম্বে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়ার দাবি পুনর্ব্যক্ত করেন।
১৯৭১-এর জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রাখতে ব্রিটিশ এবং ইউরোপীয় রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক, মানবাধিকার কর্মী এবং শিক্ষাবিদদের মাঝে সচেতনতা তৈরি করাই ছিল এ সিম্পোজিয়ামের মূল লক্ষ্য।
সাবেক ডাচ এমপি হ্যারি ভ্যান বোমেল বলেন, নেদারল্যান্ডসে আমরা যে প্রচারণা চালাচ্ছি তা শেষ পর্যন্ত ডাচ পার্লামেন্টে জেনোসাইডকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাবের দিকে নিয়ে যাবে। যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই স্বীকৃতির বিষয়টি ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক বিতর্কের অংশ হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে ব্রিটিশ ও আমেরিকার অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ে ডাচ ক্যাম্পেইন অন্যান্য দেশে ক্যাম্পেইন শুরুর জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে বলে হ্যারি আশা প্রকাশ করেন।
কিংস কলেজ, যুক্তরাজ্যের যুদ্ধ অধ্যয়ন বিভাগের একজন ব্রিটিশ-পাকিস্তানী সিনিয়র ফেলো ড. আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, আমরা পাকিস্তানীরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, বর্তমান বাংলাদেশের বাঙালীদের যন্ত্রণার অংশীদার হয়েছি এবং আমরা সে যন্ত্রণা ভাগ করে নিয়েছি।
তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তান তখন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। তা সত্ত্বেও ১৯৪৭ সালের পরের সরকারগুলো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে। বাঙালিরা তখন যে জেনোসাইডের সম্মুখীন হয়েছিল, তা এখনও পাকিস্তানে অব্যাহত রয়েছে, যা বেলুচ, সিন্ধি এবং দক্ষিণ পাঞ্জাবের লোকেরাও ভোগ করছে।
বক্তারা বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে চলমান ভূ-রাজনৈতিক স্নায়ুযুদ্ধের কারণে ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত এই ন্যাক্কারজনক জেনোসাইড এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি। যুগ যুগ ধরে পাকিস্তানের উদ্দেশ্য প্রণোদিত রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক প্রচারণার কারণে ১৯৭১-এর জেনোসাইডের শিকার লাখো লাখো নারী ও পুরুষ এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা এখন পর্যন্ত এই জেনোসাইডের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত। তারা জেনোসাইডের ও নির্যাতনের শিকার বিশ্বের সকল জাতি-গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধভাবে একই মঞ্চে এসে তাদের ন্যায্য অধিকার এবং ন্যায় বিচারের জন্য দাবি তোলার আহ্বান জানান।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্রিটেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেসময়কার ব্রিটিশ পররাষ্ট্র বিষয়ক সিলেক্ট কমিটির চেয়ারম্যান স্যার পিটার শোর এমপি ব্রিটিশ সংসদে পাকিস্তানি নৃশংসতার নিন্দা জানিয়ে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। পরবর্তীতে ২৩৩ জনেরও বেশি সংসদ সদস্য বাংলাদেশে জেনোসাইড বন্ধ এবং বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন জাতি হিসাবে স্বীকৃতি চেয়ে আরেকটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
বাংলাদেশের জেনোসাইড বিংশ শতাব্দীতে প্রত্যক্ষ করা জঘন্যতম হত্যাকান্ডের একটি। বাংলাদেশ সরকারের মতে, ১৯৭১ সালের নয় মাস যুদ্ধকালে আনুমানিক ৩০ লাখ মানুষ নিহত হয়, ২ লাখেরও বেশি নারী নির্যাতনের শিকার হয় এবং ১ কোটি মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশের জেনোসাইড আজ ইতিহাসের একটি বিস্মৃত অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে। ইবিএফের দাবি, নৃশংসতার শিকার লাখো নারী-পুরুষ এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের ন্যায়বিচার উপহার দিতে ১৯৭১ সালের জেনোসাইডকে অনতিবিলম্বে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
ইবিএফ যুক্তরাজ্যের সভাপতি আনসার আহমেদ উল্লাহর সভাপতিত্বে সিম্পোজিয়ামে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনের মিনিস্টার শেখ মো. শাহরিয়ার মোশাররফ, যুক্তরাজ্যের সিনিয়র সাংবাদিক ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন, জার্মান মানবাধিকার কর্মী ক্লডিয়া ওয়াডলিচ, বেলজিয়ামের সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ অ্যান্ড কো-অপারেশন (ডিআরসি-গ্লোবাল) এর সিনিয়র গবেষক অধ্যাপক ডা. তাজিন মুর্শিদ, বাংলাদেশের নিউ এজ পত্রিকার সাবেক সম্পাদক সৈয়দ বদরুল আহসান, ইরানি-বালুচ মানবাধিকার কর্মী রেজা হোসাইন, ইবিএফ-নেদারল্যান্ডস এর সভাপতি বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া, ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর সেক্যুলার বাংলাদেশ, সুইজারল্যান্ড এর সভাপতি রহমান খলিলুর মামুন, স্বাধীনতা ট্রাস্ট ইউকে’র নির্বাহী সদস্য ভাল হার্ডিং, ডাচ শিক্ষাবিদ এবং বুদ্ধিজীবী ভিলেম ফন ডের গিস্ট এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের এসওএএস-এর চার্লস ওয়ালেস ভিজিটিং ফেলো সাদ এস খান।
সিম্পোজিয়ামটি ব্রিটিশ বাংলা নিউজ টিভি এবং দ্য নিউ সান বাংলা পোস্টের ফেসবুক এবং ইউটিউব প্ল্যাটফর্ম থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রবাসী বাঙালী, মুক্তিযোদ্ধা, জেনোসাইড বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা অংশ নেন।
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিম্পোজিয়ামে ’৭১-এর জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দাবি
- যায়যায়কাল
- এপ্রিল ২৬, ২০২৩
- ১১:৪৫ অপরাহ্ণ
Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on tumblr
Tumblr
Share on telegram
Telegram