বৃহস্পতিবার, ৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ,২২শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

এর সর্বশেষ সংবাদ

আওয়ামী সিন্ডিকেটেই চলছে পায়রা তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প, ধরাছোঁয়ার বাইরে সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিদ্যুতের মাফিয়া খ্যাত খোরশেদুল আলম

Oplus_131072

এস আই খান: শ্রম ও আইন অনুযায়ী পায়রা ১৩২০ মেঘাওয়াট তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্পের লভ্যাংশ আদায়, শ্রমিক হয়রানি বন্ধ ও প্রকল্পের সকল দুর্নীতির তদন্ত করে বিচারের দাবিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনের মুখে ব্যবস্থাপনা পরিচালক দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী খোরশেদুল আলম চাপের মুখে বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করলেও এখনো তার সিন্ডিকেটেই চলছে প্রকল্পের সকল কার্যক্রম। ফলে পায়রা তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পে দুর্নীতির যে মহোৎসব চলছিল, আওয়ামী সরকার পরিবর্তনের পরেও তারই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে এখনো। নিজেদের ন্যায্য পাওনা আদায়ে অনেকটা বাধ্য হয়েই প্রকল্পের ভুক্তভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীগন দ্বারস্থ হয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বারান্দায়।

পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাংলাদেশ- চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল) কর্তৃক বাস্তবায়িত হয়েছে। এই কোম্পানিটি মূলত বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি এবং চাইনিজ সরকারি প্রতিষ্ঠান সিএমসির একটি জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি অর্থাৎ সরাসরি বাংলাদেশ সরকারের ৫০% এবং চায়না সরকারের মালিকানায় ৫০% বিনিয়োগ করা হয়েছে ।

প্রতিষ্ঠানটির সদ্য সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী খোরশেদুল আলমের দুর্নীতি ওয়াসার তাকসিম এ  খানকেও ছাড়িয়ে গেছে শতগুন। পতিত আওয়ামী সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানার সাথে সরাসরি ঘনিষ্ঠতার কারণে কোন চেয়ারম্যানই তাকে সরাতে পারেনি। প্রকৌশলী খোরশেদুল আলম ৭২ বছর বয়সেও বিভিন্ন সময়ে মেয়াদ বাড়িয়ে একই সাথে নিয়ম বহির্ভূতভাবে সরকারি মালিকানাধীন নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি সহ মোট তিনটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কাজ করে গেছেন। বর্তমান বিপ্লবী সরকারের আমলেও তিনি স্বপদে বহাল থাকতে চাইনিজ এম্বাসি, বিএনপি পন্থী নেতা, ছাত্র সমন্বয়ক ও সাংবাদিকদের মাধ্যমে ব্যাপক চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। কিন্তু খোরশেদের শেষ রক্ষা হয়নি।

কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৪ জানুয়ারি ২০২৫ এই দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী খোরশেদুল আলম অনেকটা বাধ্য হয়েই পদত্যাগ করেন। পদত্যাগ করার দুই সপ্তাহ আগে ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীগন “ওয়ার্কার পার্টিসিপেশন প্রভিডেন্ট ফান্ড” (WPPF) এর ন্যায্য  পাওনা টাকা আটকে দিতে সু-কৌশলে  শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে কোম্পানি কর্তৃক নিয়োগকৃত আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন এর মাধ্যমে একটি রীট পিটিশন দাখিল করেন, রিট নাম্বার-১৬৪৬৭/২৪। যদিও এই “ওয়ার্কার পার্টিসিপেশন প্রভিডেন্ট ফান্ডে’র ন্যায্য পাওনা আদায় করতে কর্মকর্তা-কর্মচারীগন এরও ১ মাস ৫ দিন পূর্বে ২৫ শে নভেম্বর ২০২৪ এ উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করেন। যাহার রিট পিটিশন নং ১৫৭১৭/২৪। কর্মকর্তা-কর্মচারীগন কর্তৃক দাখিলকৃত রিট পিটিশনের কাউন্টার হিসেবে প্রকৌশলী খোরশেদুল আলম ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন এর মাধ্যমে এক মাস পাঁচ দিন পর পাল্টা রিট পিটিশন দাখিল করেন।

বাংলাদেশের শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী লভ্যাংশের ৫% প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ থেকে বাগানের মালি পর্যন্ত সকলের মধ্যে সমানভাগে বিতরণ করার নিয়ম রয়েছে। আইন অনুযায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই লভ্যাংশের টাকা বন্টন করা হয়। পরবর্তীতে কোম্পানির লাভের পরিমান বেড়ে গেলে চক্রান্ত করে ব্যবস্থাপনা পরিচালক  প্রকৌশলী  খোরশেদুল আলম (সাবেক ম্যানেজিং ডিরেক্টর) শ্রমিকদের মধ্যে লভ্যাংশ প্রদানের নিয়মটি নিজের আওয়ামী ক্ষমতাবলে বন্ধ করে দেয়। এর পরিবর্তে প্রকৌশলী  খোরশেদুল আলম ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে নিজস্ব উদ্যোগে ইনসেনটিভ বোনাস চালু করে নিজেদের মধ্যে লাভের টাকা বন্টন করে নেয়ার পদ্ধতি চালু করে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের পাঁচ বছরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ন্যায্য (ডব্লিউপিপিএফ) এর আনুমানিক ৩০৭ কোটি টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয় প্রকৌশলী খোরশেদ ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। শেখ হাসিনার সাথে সরাসরি যোগসাজুস থাকার কারণে ওই সময় তার এমন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা টু শব্দটি করার সাহস পেত না । যদি কেউ এর বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ করার চেষ্টা করতো তাহলে তাকে চাকরীচ্যুত করার হুমকি দেয়া হতো। লভ্যাংশের এই ন্যায্য টাকা আদায়ের জন্যই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যখন আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করে তখন নিজের পিঠ বাঁচাতে এবং এই টাকা দেওয়া বন্ধ রাখতে আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন এর মাধ্যমে “লভ্যাংশের এই টাকা শ্রমিকদের দেয়া যাবে কিনা” মর্মে উচ্চ আদালতে একটি প্রহসনমুলক রিট দায়ের করেন। উদ্দেশ্য শ্রমিকদের রিট আবেদনের রায় কে বিলম্বিত করা ও প্রতিহত করা।  এজন্য আইনজীবীর সাথে তিনি আনুমানিক ১৪.৫ কোটি টাকার কন্টাক্ট করেন। যার নথিপত্র এখন প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে।

ম্যানেজমেন্টের সাথে যোগাযোগ করে গোপন সূত্রে জানা যায় চুক্তির অর্ধেকের বেশি টাকা ইতিমধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে বহাল থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাকেও ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুষ দেয়ার চেষ্টা করেছেন প্রকৌশলী খোরশেদুল আলম। কিন্তু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত ১৪ জানুয়ারি ২০২৫ এ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তবে পদত্যাগ করলেও প্রকৌশলী খোরশেদুল আলমের দোসরদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এখনো চলছে প্রকল্পের সকল কার্যক্রম।

প্রকৌশলী খোরশেদুল আলমের গার্লফ্রেন্ড খ্যাত বর্তমানে কারান্তরীন আওয়ামী লীগ সরকারের সিরাজগঞ্জ-০২ আসনের দুর্নীতিবাজ এমপি জান্নাত আর হেনরী। সামান্য স্কুল শিক্ষিকা থেকে হেনরিকে সংসদ সদস্য বানানো এবং তার স্বামী লাবু তালুকদারকে জেলা পরিষদের প্রশাসক বানানোর ক্ষেত্রে খোরশেদুল আলম প্রচুর টাকা ব্যয় করেছেন। এই হেনরিই ছিল মূলত খোরশেদুল আলমের দুর্নীতির প্রধান কারিগর। হেনরির তদবিরেই এই প্রকল্পে সিরাজগঞ্জ ও জামালপুরের অর্ধ শতাধিক লোককে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। আশ্চর্যের বিষয় বর্তমান সরকা্রের আমলে দুর্নীতি ও গণহত্যার মামলায় জান্নাত আরা হেনরি ও তার স্বামী লাবু তালুকদার কারাগারে থাকলেও পায়রা তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজের কমিশনের টাকা তাদের একাউন্টে ঠিকই পৌঁছে যাচ্ছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ খাতের ম্যারাডোনা খ্যাত দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী খোরশেদুল আলম শুধু পদত্যাগ করেই যেন পার পেয়ে গেছেন। বিগত ১৬ বছরের তার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির বিচার এখন সময়ের দাবি। অথচ প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বহাল তবিয়তে দেশে আরাম আয়েশেই আছেন পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তা।

প্রায় এক হাজার একর আয়তনের পায়রা তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের সকল রাস্তাঘাট, পুকুর, আবাসন, ৬ টি স্টাফ ডরমেটরি ভবন, ৮ কোয়াটার ভবন, ১টি অফিসার কোয়ার্টার ভবন, ৪ টি অফিসার ডরমেটরি ভবন (সবগুলো পাঁচতলা বিশিষ্ট), ১ টি ক্যাফেটেরিয়া, ১ টি মসজিদ ( নির্মাণাধীন প্রকল্পের ব্যায় আনুমানিক ৭০ কোটি টাক)  ১ টি ভিআইপি ভবন ( নির্মান ব্যায়-৩০ কোটি), একটি নৌকা সদৃশ ক্যাফেটেরিয়া-নির্মাণ ব্যায় ৬০ কোটি টাকা ও ১ টি ভিভিআইপি ভবন যা শুধুমাত্র শেখ হাসিনার জন্য বানানো হয়েছিল ৫২ কোটি টাকা খরচ করে।

শেখ হাসিনা সেই ভবনে মাত্র ৩ ঘন্টা অবস্থান করেছিলেন তারপর থেকে ভবনটি খালি পড়ে আছে।  কনস্ট্রাকশনের হাজার হাজার কোটি টাকার বেশিরভাগ কাজই প্রকৌশলী খোরশেদুল আলম টেন্ডার দাখিল নিয়মের কোন তোয়াক্কা না করে  দিয়েছেন জান্নাত তারা হেনরির স্বামী লাবুর মালিকানাধীন লাম এন্টারপ্রাইজ নামক কোম্পানিকে । বর্তমানে খোরশেদ এর পদত্যাগের পর এই লাম এন্টারপ্রাইজ নিজ কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে ইরা এন্টারপ্রাইজের কাঁধে ভর দিয়ে তাদের সব ধরনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এবং শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন , যাহার বড় একটি অংশ দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী খোরশেদুল আলমের অ্যাকাউন্ট এ চলে যাচ্ছে। লাবুর ভাতিজার মালিকানাধীন আরেকটি প্রতিষ্ঠান রাস এসোসিয়েটও প্রকৌশলী খোরশেদুলের হয়ে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ করে যাচ্ছে।

প্রকৌশলী খোরশেদুল আলমের নিয়োগ বাণিজ্য, পাওয়ার প্ল্যান্টের অবকাঠামো নির্মাণ কাজের দুর্নীতির শ্বেতপত্র এই প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে। পর্যায়ক্রমে পাঠকের উদ্দেশ্যে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে।

অনুসন্ধানকালে পায়রা তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের কর্মকর্তা–কর্মচারীগন এই প্রতিবেদকের কাছে তীব্র ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার অনেক মন্ত্রী, এমপি, ব্যবসায়ী এমনকি আইনজীবী পর্যন্ত এখন বিচারের মুখোমুখি হয়ে কারাগারে অবস্থান করছে। কিন্তু কিভাবে মহা দুর্নীতিবাজ এই প্রকৌশলী খোরশেদুল আলম এখনো আইন ও বিচারের পাশ কাটিয়ে বহাল তবিয়তে কারাগারের বাইরে বিলাসী জীবনযাপন করছেন ? তাহলে কি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও দুর্নীতি লব্ধ টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে নিয়েছেন বিদ্যুৎ খাতের ম্যারাডোনা খ্যাত প্রকৌশলী খোরশেদুল আলম?

উল্লেখ্য বিষয় এই যে, আওয়ামী সরকার ও খোরশেদুল আলম ক্ষমতায় না থাকলেও তাদের মাধ্যমে অবৈধভাবে নিয়োগকৃত বিভিন্ন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জুলাই ২৪ এর ছাত্র আন্দোলন এবং বর্তমান অন্তঃবর্তীকালীন সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য বিভিন্নভাবে আওয়ামী কায়দায় পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অভ্যন্তরে খোরশেদের ইন্ধনে অরাজগতা সৃষ্টি করার পায়তারা করতেছে এবং কর্মকর্তা -কর্মচারীদের ন্যায্য পাওনা WPPF এর মামলাকে দীর্ঘায়িত করার নিমিত্তে সুপরিকল্পিত ভাবে আওয়ামি চক্রকে কাজে লাগাচ্ছে। যেসব ব্যাক্তিকে দিয়ে এইসব কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে তদের প্রত্যেকের প্রোফাইল পর্যালোচনা করে দেখা যায় তাহারা এখনো কোন কোন ভাবে আওয়ামী কার্যকলাপের সাথে  সরাসরি সংযুক্ত রয়েছে যাহা ২৪ এর জুলাই আন্দোলনকে চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

অবিলম্বে তাকে দুর্নীতি দমন কমিশনের আওতায়  এনে গ্রেফতার করে  বিচারের মুখোমুখি করার জোর দাবি জানান প্রকল্পের কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

পায়রা তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের সদ্য পদত্যাগ করা দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী খোরশেদুল আলমের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি কল রিসিভ করেন নাই।

 

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Tumblr
Telegram

বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

যায়যায়কাল এর সর্বশেষ সংবাদ