বৃহস্পতিবার, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ,১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

এর সর্বশেষ সংবাদ

“একুশ” আমাদের দর্পণ : ডা. মোঃ সাইফুল ইসলাম

ডা. মো. সাইফুল ইসলাম: আমাদের মাতৃভাষা অর্থাৎ বাংলা ভাষা। যে ভাষাতে মা আদর করে স্নেহ করে, ভালবাসে। যে ভাষাতে আমাদের বোল ফোটে, হাসি, কাঁদি, গান গাই, যে ভাষাতে প্রেমপ্রীতি, মায়ামমতা ভরা এক মাধুরীমাখা শিহরণ জাগে। যে ভাষা আমাদের পারস্পারিক ভাবপ্রকাশের মাধ্যম। যে ভাষা মানুষে মানুষে মধুর ও পরিস্থিতি বিশেষে তিক্ত এবং বৈরী সম্পর্কের সেতু বন্ধন রচনা করে, যে ভাষা আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতির ধারক, বাহক, সেই ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার পশ্চাতে রয়েছে এক হৃদয়বিদারক ইতিহাস জড়িত।

স্বার্থ, ক্ষমতা ও আধিপত্যের লোভে মানুষ যে কত নির্মম, নিষ্ঠুর ও বর্বর হতে পারে তার জ্বলন্ত প্রমাণ ১৯৫২ সাল একুশে ফেব্রুয়ারী। একুশে ফেব্রুয়ারীর পশ্চাতের ইতিহাস এক বেদনাদায়ক ইতিহাস। যে ইতিহাস পাকিস্তানী স্বার্থবাদী মহলের জঘন্যতম ষড়যন্ত্রের ইতিহাস।

আমরা মুসলমান, ধর্মকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। তাই ধর্মীয় চেতনায় ইসলামের ছায়াতলে আবদ্ধ হয়ে ১৯৪৭ সালে ১৪ আগষ্ট ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়। আর সেই থেকেই ইসলাম ধর্মের নামে আমাদের উপর একের পর এক ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে লাগলো পাকিস্তান শাসক মহল। সকল সুযোগ সুবিধা থেকে আমরা হতে থাকলাম বঞ্চিত। শুরু হলো বিমাতা সুলভ আচরণ, যে আচরণ আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও অস্তিত্ব বিলুপ্ত করার এক নির্লজ্জ ও জঘণ্য ষড়যন্ত্র। এধরনের ষড়যন্ত্র কোন জাতিই মেনে নিতে পারে না।

পৃথিবীতে বহু প্রজাতির প্রাণী আছে। মানুষ নামক এই প্রজাতি স্বার্থ, ক্ষমতা ও অস্তিত্বের প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন জাতি ও ধর্মে বিভক্ত হয়েছে। এই জাতিগত ও ধর্মীয় কারণেই আলাদা আলাদা দেশ বা ভূখন্ডের সৃষ্টি হয়েছে। আলাদা দেশ বা ভূখন্ড প্রতিষ্ঠিত করার পশ্চাতে রয়েছে অনেক বেদনাবিধূর ইতিহাস। ঝরেছে কত রক্ত, দিতে হয়েছে কত জীবন। আজও পৃথিবীর অনেক দেশে আলাদা দেশ বা ভূখন্ডের জন্য রক্ত ঝরছে। স্বাধীনতাকামী মানুষের উপর চালানো হচ্ছে অমানবিক নির্যাতনের ষ্টীম রোলার। তবে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রæয়ারীর ইতিহাস কিন্তু আলাদা দেশ বা ভূখন্ড প্রতিষ্ঠিত করার ইতিহাস নয়। এ এক ব্যতিক্রমধর্মী ইতিহাস। এ ধরনের ইতিহাস পৃথিবীর আর কোন দেশে নেই। তারপরও এ ইতিহাস শুধু বাঙ্গালি জাতিরই ইতিহাস নয়। এ ইতিহাস বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত ও অবহেলিত মানুষের ইতিহাস।

একটি কথা প্রচলিত আছে যে, কোন জাতিকে ধ্বংস করতে হলে প্রথমে ধ্বংস করতে হবে সে জাতির সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে। এই মানসিকতা নিয়েই পাকিস্তানী কুচক্রী মহল প্রথমে আক্রমণ করছিল আমাদের প্রাণের ভাষা, মধুর ভাষা, মাতৃভাষাকে। এই আক্রমণ শুধু ভাষার উপরে নয় কারণ শিশু জন্মের পর একমাত্র মায়েই শিশুর চেতনা ও চেতনাবোধকে তার নিজস্ব ভাষায় জাগ্রত করে তোলে। মাকে কেউ গালি দিলে, খারাপ বললে অর্থাৎ মায়ের অপমানসূচক কথা শুনলেই ছেলে যেমন তার দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলে এবং সংগে সংগেই প্রতিবাদমূখর হয়ে ওঠে। আঘাত, নির্যাতন, জয়পরাজয় এমন কি রক্ত ঝরাতে ও মৃত্যুকে হাসিমুখে বরণ করতে প্রস্তুত হয়ে যায়। এ মহা সত্যে জ্বলন্ত প্রমান ১৯৫২ সাল মহান একুশে ফেব্রুয়ারী।

পাকিস্তানি কুচক্রী মহল যখনই মাতৃভাষাকে বিলুপ্ত, পঙ্গু ও স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য স্বৈরাচারী ভাষণের মাধ্যমে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে ঘোষণা করলো আর তখনই বাংলা মায়ের সোনার ছেলেরা এই অপমান সূচক ঘৃণা ষড়যন্ত্রকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠলো। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবীতে দেওয়ালে দেওয়ালে পোষ্টার, ফেষ্টুনে ছেঁয়ে গেল। শ্লোগানে, শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠলো বাংলার আকাশ বাতাস। স্নেহময়ী মায়ের আশির্বাদ পুষ্ট হয়ে সোনার ছেলেরা প্রতিক্ষা করলো। প্রয়োজনে আমরা রক্ত দিবো, মৃত্যুকে হাসি মুখে বরণ করে নিবো। তবু বাংলা ভাষা অর্থাৎ মাতৃভাষার মান রক্ষা করবো।

সেদিনের সেই অগ্নিঝরা মাসটি ছিলো ফাল্গুন মাস অর্থাৎ ৮ই ফাল্গুন ও বসন্তকাল। ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে যেমন কলি থেকে ঘুমন্ত ফুলগুলো বিকশিত হয়ে সমস্ত সুবাস ও নির্জাস বিলীন করে নিঃশেষ হয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। ঠিক তেমনি ভাবে ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারী অর্থাৎ ৮ই ফাল্গুন স্নেহময়ী মায়ের প্রসারিত কোমল বুক থেকে সবকটি আদরের ছেলেরা নেমে এসেছিল মাটির পৃথিবীতে রাজপথে, রাস্তায়। ফুটেছিল প্রতিবাদী দৃপ্ত কণ্ঠ। হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদমুখর। ছাত্র-জনতা আবাল, বৃদ্ধ, বনিতার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। এ যেন শ্বাশত সত্যের এক মহনীয় বলিষ্ঠ উচ্চারণ। এ উচ্চারণ সমগ্র বাংঙ্গালি জাতিকে শক্তি বিকাশে ও সাফল্যের সোনার দ্বারে পৌঁছানোর দৃঢ় প্রত্যয়ে আবদ্ধ করলো।

বাংলা মায়ের দামাল সন্তানদের গতি যখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলো আর তখনই পাকিস্তানী কুচক্রীমহল ষ্টেনগান, মেশিনগানের গুলি বেপরোয়াভাবে ছাত্র জনতার শান্তিপ্রিয় মিছিলের উপর চালাতে লাগলো। সংগে সংগেই ঢাকার পীচঢালা রাস্তায় লুটিয়ে পড়লো শহীদ, বরকত, সালাম, জোব্বার, রফিক ও আরও কত নাম না জানা সোনার ছেলে। অকালেই ঝরে গেল কত তরুণ তাজা প্রাণ, খালি হলো কত মায়ের কোল। কিন্তু এ মৃত্যু তো মৃত্যু নয়। এ যেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামের অঙ্গীকার ও চেতনা ও চেতনাবোধের সুতিক্ষè হাতিয়ার। বাঙ্গালি জাতির আগামী দিনের মুক্তির আহ্বান, এ যেন স্নিগ্ধ ভূবন, ছায়াময় জীবন গড়ার শপথ। পাকিস্তানি শাসক মহলের ষ্টেনগান, মেশিনগান, রক্ত ও মৃত্যু কোন কিছুই স্তব্ধ করে দিতে পারলো না ভাষা আন্দোলনকে। বরং সকল বাধা ও ষড়যন্ত্র ও নির্যাতনকে অতিক্রম করে দ্রæত গতিতে এগিয়ে যেতে লাগলো বাংলা মায়ের দামাল সন্তানেরা, আন্দোলনের প্রখরতার কাছে, কেঁপে উঠলো শাসক ও শোষকের ষড়যন্ত্রের ভীত। বে-সামাল হয়ে পড়লো শাসক মহল। বেগতিক দেখে কুচক্রী শসকমহল স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তটি অর্থাৎ রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে সিদ্ধান্তটি স্থগিত ঘোষণা করতে বাধ্য হলো। বাংলার দামাল ছাত্র-জনতার কাছে পরাজিত হলো পাকিস্তানী শাসকমহল। তার মুছে দিতে পারলো না শহীদদের নাম, ভেঙ্গে দিতে পারলো না আন্দোলনের ভীত। বাঙ্গালী জাতি পেল বিজয়ের স্বাদ। এ বিজয় বাঙ্গালী জাতিকে দিল সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। গড়ে তুললো শহীদ মিনার। সেদিনের সেই মৃত্যু ও রক্ত দেখালো সমগ্র জাতিকে আগামী দিনের স্বপ্ন। একুশের চেতনা ও চেতনাবোধই বাঙ্গালী জাতিকে উপহার দিয়েছে কাঙ্খিত প্রত্যাশার চুড়ান্ত অর্জন “স্বাধীনতা”।

একুশ শুধু অতীতের স্মৃতি নয়। একুশ হচ্ছে বাঙ্গালী জাতির জীবন ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থায় রয়েছে দর্শনীয়ভাবে নিজেকে উপভোগ, উপহার ও উপস্থাপনের দিক নির্দেশনা। একুশ আমাদের ভবিষ্যৎ, সুস্থ ও সুন্দর জীবন ব্যবস্থার নিশ্চয়তার প্রতীক। একুশ আমাদের দর্পণ। এ দর্পনেই পাওয়া যাবে আমাদের সকল সমস্যা সমাধানের পথ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, একুশের শিক্ষাটা কি? শিক্ষা এই যে, সমষ্টির পক্ষে কোন বিজয়ই অসম্ভব নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, বাঙ্গালীর মিত্র কে? প্রধান মিত্র বাংলা ভাষা অর্থাৎ মাতৃভাষা। এ ভাষাই আমাদের পরিচয়ের ঐক্যের সূত্র। এ সূত্রই বাঙ্গালী জাতির একমাত্র মুক্তির পথ।

আমাদের রক্তে কেনা অতীত অর্জনগুলো যা বহিঃবিশ্বে অনন্য গৌরবজ্জ¦ল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বাঙ্গালির দর্পণে সমগ্র বিশ্বের অধিকার আদায়ে পিছিয়ে পড়া মানুষগুলো দেখতে পাচ্ছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ। আমাদের একুশ আজ সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র বিশ্বে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রæয়ারীর ভাষা আন্দোলন বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসাবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেয়েছে। এ স্বীকৃতি বাঙ্গালি জাতির জন্য একটি শ্রেষ্ঠ অর্জন। এ স্বীকৃতি শুধু শহীদদের মহিমান্বিতই করেনি মায়ের মর্যাদাকেও উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

সেই সংগে আমাদের একুশ সমগ্র বিশ্বে অমরত্ব লাভ করেছে। কাজেই অতীত অর্জনগুলো থেকে আমাদেরকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় দেশ ও জাতির অগ্রগতি, অনুন্নয়ন, স্বয়ং সম্পূর্ণতা, নিরাপত্তা, সুস্থ রাজনীতি, সুন্দর জীবন, সুখ ও শান্তি কোন কিছুই অর্জন করা সম্ভব নয়। সত্য কথা বলতে কি একুশ আমাদের গর্ব, একুশ আমাদের অহংকার এই উপলব্ধি টুকু সবার মাঝে জাগ্রত হোক প্রত্যাশায় সবাইকে ধন্যবাদ।

লেখক: ডা. মোঃ সাইফুল ইসলাম
কবি, সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক
চিলাহাটি, ডোমার, নীলফামারী।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on tumblr
Tumblr
Share on telegram
Telegram

বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

যায়যায়কাল এর সর্বশেষ সংবাদ