বুধবার, ৪ঠা আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ,১৮ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

এর সর্বশেষ সংবাদ

ক‌ষ্টে ভরা বে‌দে জীবন জী‌বিকা! সঙ্গে বাড়ি সঙ্গে ঘর, এদের নাম যাযাবর

মীর আমান মিয়া লুমান, ছাতক(সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি: সুনামগ‌ঞ্জের ছাতকে গো‌বিন্দগঞ্জ ও সৈ‌দেরগাও ইউ‌পির আব্দুল হক স্মৃ‌তি ডি‌গ্রি ক‌লেজ ও গো‌বিন্দনগর ফজ‌লিয়া আলীয়া মাদ্রাসার রেল লাই‌নের পা‌শে বালুর খোলা মাঠ। এ মা‌ঠে ছোট ছোট তাবু টা‌ঙ্গি‌য়ে অস্থায়ীভাবে পা‌নি কাগজ দি‌য়ে মোড়া‌নো হ‌চ্ছে ছোট ঘর। এই ঘ‌রেই ১০জনের এক‌টি প‌রিবার বসবাস কর‌ছেন। ২০টি বেদে পরিবারে শতাধিক মানুষের বসবাস কর‌ছেন ক‌য়েক বছর ধ‌রেই গো‌বিন্দগঞ্জ এলাকায়। তাদের জীবন জী‌বিকা কাঠফাটা রোদ আর তীব্র ভ্যাপসা গরমে নাভিশ্বাস। দুপুর বেলায় কাঠফাটা রোদের তাপে প্রাণটা দেহ থেকে বের হয়ে যাওয়ার অবস্থা। বেদে পরিবারে জন্ম নেয়াই যেন তাদের আজন্ম পাপ।

যাযাবরদের জীবন জী‌বিকা নি‌য়ে সাধারণ মানুষের বহুকাল ধরেই প্রচণ্ড আগ্রহ আ‌ছে। ছোটবেলায় শুনেছিলাম, ‘সঙ্গে বাড়ি সঙ্গে ঘর, এদের নাম হ‌চ্ছে যাযাবর।’ বলতে গেলে, যাযাবরদের কোনো ঘর নেই, বাড়ি নেই। অধিকাংশই সাথে তাঁবু নিয়ে চলাচল ক‌রছেন। যেখানেই রাত, সেখানেই কাত হয়ে পড়ে তারা। তাঁবুতে, পাহাড়ের গর্তে, গাছের কোঠরে কোনো ভাবে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেয়। বৃষ্টির পানি বা রোদ এড়ানোই মুখ্য। এসব বাড়িতে সৌন্দর্যের কোনো বালাই নেই। কোনো রকম রাত্রিযাপন করাই তা‌দের উদ্দেশ্য। আধুনিক সভ্যতার কোনো নিদর্শনই তাদের মধ্যে দেখা যায় না।

যাযাবরদের প্রথম পরিচয় তাদের নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা ও নেই। নেই জীবিকা অর্জনের জন্য সভ্য মানুষের রীতি। ধরাবাঁধা চাকরি নেই। ব্যবসা যারা করে সেটাও সাময়িক। নিরন্তর ছুটে চলা এক জীবনের পথিক। ইতিহাস বলে বে‌দে সম্প্রদায়ের মানুষ বেছে নিয়েছে এমন ছন্নছাড়া জীবন যাপন। এই মধ্যে রয়েছে আকস্মিক জীবন সংগ্রাম যুদ্ধ। তারা উপায় না পেয়েই এসব মানুষগুলো যাযাবর জীবন জী‌বিকা চরম মান‌বেতর কাটা‌চ্ছেন।তবে দুর্গম অঞ্চলে যাযাবরদের বিচরণ বেশি দেখা মেলে। দুর্গম খা‌লি মা‌ঠে কিংবা গহিন অরণ্যে দলবেঁধে থাকে তারা। আবার ও জলের ওপর ভাসমান নৌকায়, তুষারাচ্ছন্ন পরিবেশ থেকে শুরু করে মরুভূমির মাঝেও থাকে ওরা। বংশ পরম্পরায় এই যাযাবর জীবনই তাদের পরিচয় হয়ে ওঠে। তবে বর্তমানে তাদের সংখ্যা অনেকাংশেই কমে গেছে এখন। যাযাবর পেশা ছেড়ে অনেকেই অন‌্যপেশায় পা‌ড়ি দি‌য়ে‌ছে। তাদের জীবন যাপন সত্যিই রহস্যময়। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দেখা যায়। অঞ্চল ভেদে একেক নাম, আর বেঁচে থাকার বিচিত্রসব পেশা। নর-নারী, শিশুর অদ্ভুত তাদের চেহারা, অদ্ভুত তাদের কথাবার্তা। যাযাবর বলেই এদের জীবন বৈচিত্র্যময়। বৈচিত্র্যময়তাই এদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বেদেরা জীবনকে একঘরে রাখতে চায় না, প্রকৃতির ভালোবাসাকে স্বীকার করে নেয়।

সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেছেন, মানুষ স্বভাবতই সামাজিক জীব। কিন্তু এরা নির্দিষ্ট কোনো সমাজে আবদ্ধ নয়। ঘুরে বেড়ায় খেয়াল খুশি ইচ্ছা মতো। এতেই তারা আনন্দ পায় অ‌নে‌কেই। তাদের মাঝে কখনোই অসন্তুষ্টির ছাপ চোখে পড়ে না।
গত বুধবার বিকা‌লে গো‌বিন্দগঞ্জ এলাকার বেদে সরদার মোহাম্মদ আ‌নিছ মিয়া (৫৯) তার স্ত্রী ঝুলনা বি‌বি, সুমন, রা‌বিনা খাতু‌ন ও সা‌লেমা খাতু‌নের সঙ্গে আলাপ আ‌লোচনায় হয়। সুনামগঞ্জ সদর উপ‌জেলার সোনাপুর গ্রা‌মে তা‌দের বা‌ড়ি। তা‌দের বা‌ড়ি ঘর সুরমা নদীর ভাঙ্গ‌নে কব‌লে প‌ড়ে নিংস্ব হ‌য়ে‌ছে। তা‌দের দুঃখ ও কষ্ট গাঁথা জীবন জীবিকার নানা আকু‌তির গল্প কাহিনী। তাদের চলা ফিরাই সাদামাটা জীবনযাপন । জীবনের সাথে যুদ্ধ করে প্রতিটি দিন রাত তারা কাটায়। একটু সুখের জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা কঠোর পরিশ্রম করে চল‌ছে। ওরা রহস্যময় মানুষ। তারা যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ায় এখানে-ওখানে। স্থান ভেদে তাদের একেক নাম, আর বেঁচে থাকার জন্য বিচিত্র্যসব পেশায় কাজ কর‌ছেন। বেদেদের বাহন নৌকা, পা ফে‌টে অজানা স্থা‌নে গি‌য়ে তাবু টা‌ঙ্গি‌য়ে বসবাস কর‌ছেন। অ‌নে‌কেই স‌ঙ্গে বা‌ড়ি ঘর সংসার নিয়ে ঘুরে বেড়ায় বিভিন্ন জায়গায়। যাযাবর বলেই এদের জীবন বৈচিত্র্যময়। বেদেরা জীবনকে একঘরে রাখতে চায় না, প্রকৃতির ভালোবাসাকে স্বীকার করে নি‌য়ে‌ছেন।

তাদের জীবন জী‌বিকা সংগ্রাম যুদ্ধ সম্পর্কে জানতে চাইলে, বেদে সরদার আ‌নিছ মিয়া জানালেন, স্বামীদের আঁচলে বেঁধে রাখার রহস্য। পুরুষ বশে রাখতে তারা শরীরে সাপের চর্বি দিয়ে তৈরি তেল ব্যবহার করে। তাদের বিশ্বাস এতে স্বামীরা তাদের ছেড়ে অন্য কারো কাছে যাবে না।
তারা আরও জানালেন, তারা দিনে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। তাদের আর্থিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য পেশা পরিবর্তনের সুযোগ করে দিতে পারলে এই জীবন থেকে মুক্তি পেতে পারে বেদে সম্প্রদায় নারী পুরুষ। তাবিজ-কবজ বিক্রি, জাদুটোনা আর সাপ খেলা দেখিয়ে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে হয় ছিন্নমূল, অসহায় বেদে সম্প্রদায়কে। তারা রাস্তার পাশে, ফাঁকা মাঠে বা পরিত্যক্ত জমি, খাসজমি, রাস্তার ধার, স্কুলের মাঠের পাশে অথবা নদীর তীরে অতিথি পাখির মতো অস্থায়ী আবাস গড়েন। আবার একদিন উধাও হয়ে যায়, কেউ খবর রাখে না তাদের। সময়ের আবর্তে উন্নতির পরিবর্তে বেদে সমাজের জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্দিন। নদীর রূপ বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাদের চলার পরিধি ছোট হয়ে আসছে। আর তাই তারা অনেকেই ছাড়তে শুরু করেছে নদ নদী। নদী ছেড়ে কোথায় যাবে এসব বেদে। তাদের নেই কোনো শিক্ষা, নেই কোনো কাজের বিশেষ যোগ্যতা। এভাবেই বেদের জীবনের শেষ হয়ে যায়। বেদেরাই সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত মানুষ। নৌকাতেই তাদের জন্ম আর নৌকাতেই তাদের জীবন শেষ। বাংলাদেশ সরকার কিংবা সমাজের উচ্চ শ্রেণির মানুষ যদি আমাদের একটু দেখতেন তাহলে আমরা খুবই ভালো করে জীবন অতিবাহিত করতে পারতাম, এমনটাই বললেন বেদে সরদার আ‌নিছ মিয়া। বেদেদের জীবন অধিকার বিহীন। তাদের মৌসুমী শীত, ঝড়, তুফান, গরম বুকে ধারণ করা যে কত কষ্টকর তারাই বুঝে একমাত্র। বেদেদের বাড়ি-ঘর, মাথার ওপর ছাদ, সামাজিক মর্যাদা জন্ম থেকে আজও তারা বঞ্চিত!
তারা এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ানো পাশাপাশি টেঁটা দিয়ে মাছ শিকার, সিঙ্গা, তাবিজ, ছাতা, পুরোনো তালা মেরামত, কবজ, সাপ ধরা, সাপের খেলা দেখানো এই ছিল বেদে সম্প্রদায়ের গন্তব্যহীন রাজ্যের আস্তানায় বিভোর। রাস্তার ধারে, কখনও মেঠোপথের ধারে ও ফাঁকা মাঠে ছঁই বা ঝুপড়ি, মাচা, তুলে স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা নিয়ে দিন-রাত কাটান।
লোকমুখে আছে ‘সবার উপর মানুষ সত্য তার উপর নাই’। এদেশে বেদেদের জাত প্রথার শিকার। বিশ্বে দাস প্রথা, বর্ণবাদ আজ বিলুপ্তির পথে বলা যায়। এই জাতের নিত্যদিনের জীবনযাত্রা যা দরকার তা তাদের নেই। জাতের বড়াইয়ে মানুষ হলেও যাযাবর বাইদ্যা (বেদে) বলে গণ্য গাঁও- গ্রামে। পাশাপাশি এই পরিবারের ছেলে-মেয়ে অযত্ন আর অবহেলায় বেড়ে ওঠে। শিশু-কিশোররা স্কুলে ভর্তি হওয়ার মতো মেধাসম্পূর্ণ হলেও বেদের ঘরে জন্ম নেয়াই হলো তার পাপ। তা না হলে তাদের ক্লাস করা কষ্ট হয় কেন? কী নির্মম নির্দয় এই সমাজব্যবস্থা।
দু’বেলা দু-মুঠো খাবার জোগাড় করতে পারলেই আমরা মহাখুশি। স্বামীর, স্ত্রী সাংসারিক জীবিকার তাগিদে ছুটে বেড়াই গাঁও-গ্রামে। কপালের টিপ, চুড়ি, থালা-বাসন বিক্রি ও সাপ খেলা ও বানরের নাচ দেখিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে কোনো রকমে সংসার জীবন চলে।
তারা বলেন, বেঁচে থাকার নাম হ‌চ্ছে সংগ্রাম। আমাদের খোঁজ কেউ রাখে না, আমরা যাযাবর এটাই লোকমুখে আখ্যায়িত। স্বামী-স্ত্রী যখন জীবিকার সন্ধানে ছুটে যান তখন শিশু-ছেলে-মেয়েরা পাখির মতো বন্দিশালার দৃশ্য অবাক হওয়ার মতো। কিভাবে পথ পানে চেয়ে থাকে। মা-বাবার স্নেহ কখন মিলবে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয় এই সোনামণিদের। তীব্র গরমে রাতে সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে ইলেক্ট্রিক পাখা ব্যবহার করলেও দিনের গরমে সীমাহীন ভোগান্তি, অনাদর অবহেলায় রোগ ব্যাধিতে নিঃশেষ হয়ে যায়। এদের পাশে থাকে না সমাজের কোনো ধনী শ্রেণি, থাকে না প্রশাসনের দৃষ্টি। এই বেদে পরিবারের শিশুরা সব সময় পুষ্টিহীনতায় ভোগে। সব এলাকায় যাওয়া হলেও সচেতনতার জন্য ও জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মী এবং এনজিও কর্মীরা তাদের প্রতি কতটুকু সহনশীল যা খোঁজ-খবর নেন না বলে জানান ওই পরিবার। ‘ছেলে হোক আর মেয়ে হোক দুটি নয় একটি হলে ভালো হয়’ সরকারের স্লোগান। না নেয়ার কারণে প্রতি পরিবারে ৭-৮ জনের মতো সন্তান জন্মায়। তাদের সন্তানরা অন্য ৮-১০ জনের মতো লেখাপড়া শেখে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে চায়। তখন হিমশিম খেতে হয় মা-বাবার।
যদি সরকারের সুদৃষ্টি থাকে তাহলে সম্ভব। ওদের চিকিৎসার জন্য তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা নেই। তাদের বেশিরভাগ প্রকৃতির লতাপাতা, গাছ-গাছড়ার মাধ্যমে ওষুধ তৈরি করে রোগ নিরাময় করে থাকেন। বেদেদের নিবন্ধন ও ভোট দেয়া, আইডি কার্ড প্রদান করা মৌলিক অধিকারের শামিল। কেউ কেউ আইডি কার্ড, নিবন্ধন পেয়েছে আবার কেউ কেউ পায়নি।
আক্ষেপ করে আ‌নিছ সরদার বলেন, ১০ জনের মতো বেদে পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত কর‌ছেন। সরকার আমাদের একটু খাস ভূমিতে মাথা গোঁজার ঠাঁই দিত তাহলে প্রাণে বেঁচে যেতাম।
প্রেম যেমন কোনো জাত বা প্রথা ও ধর্ম মানে না তেমনি জাতির কাছে উচ্চবর্ণ বা নিম্নবর্ণ গল্পের মতো জ্ঞাতি খুড়ার চরিত্র নয়, বেদে (বাইদ্যা) হিসেবেও নয়, ‘মানুষ’ হিসেবে সবার কাছে পরিচিতি পেয়ে থাকে।
সম্প্রদায়ের জন্য সরকার বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন স্থানে জমিসহ ঘর দিচ্ছে সরকার। সমাজসেবা কার্যালয়ের পক্ষ থেকে বিশেষ ভাতা রয়েছে। এসব ব‌্যাপারে তারা কিছু ও জা‌নেন না।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Tumblr
Telegram

বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

যায়যায়কাল এর সর্বশেষ সংবাদ