বুধবার, ১৮ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ,২রা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

এর সর্বশেষ সংবাদ

ঋণের বোঝা, ক্রেতার সংকট: হুমকিতে রংপুরের শুঁটকি আড়ৎ

আনোয়ারুল ইসলাম রনি, রংপুর: রংপুরের ঐতিহ্যবাহী দর্শনা ঘাঘটপাড়ার শুঁটকি আড়ত আজ অস্তিত্ব সংকটে। প্রায় চার দশক আগে প্রতিষ্ঠিত এই পাইকারি আড়তে এক সময় প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার শুঁটকি বিক্রি হলেও বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকায়। ক্রেতার অভাব, পুঁজি সংকট ও ব্যাংক ঋণ না পাওয়ার কারণে হুমকির মুখে পড়েছে আড়তের স্থায়িত্ব। অনেক ব্যবসায়ী বাধ্য হয়ে ব্যবসা গুটিয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।

শুঁটকি ব্যবসায়ীরা জানান, সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ ও সরকারি সহায়তা ছাড়া এই খাত টিকিয়ে রাখা কঠিন। ১৯৮০ সালে প্রায় দেড় একর জায়গা জুড়ে গড়ে উঠেছিল দর্শনার এই শুঁটকি আড়ত। শুরুর দিকে যেখানে ৫০ জনের বেশি ব্যবসায়ী সক্রিয় ছিলেন, বর্তমানে সেখানে ব্যবসায়ী আছেন মাত্র ১৬ জন। বাকিতে বিক্রি করা শুঁটকির টাকা উদ্ধার করতে না পারায় অনেকেই পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছেন।

ব্যবসায়ীদের দাবি, সুযোগ-সুবিধা পেলে এ শিল্প আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারে। তবে এর জন্য চাই আর্থিক প্রণোদনা, ব্যাংক ঋণের সহজলভ্যতা ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।

শুঁটকির মৌসুম মূলত অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাস। এ সময় চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল যেমন—চট্টগ্রাম, খুলনা, পটুয়াখালী, বরিশাল ও রাজশাহীর চলন বিল এলাকা থেকে আসা সামুদ্রিক শুঁটকি এখানে সরবরাহ হয়। এছাড়া, নীলফামারীর সৈয়দপুরের মাধ্যমে ভারতীয় এলসি শুঁটকি, এমনকি মায়ানমার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও পাকিস্তান থেকেও শুঁটকি আসে এই আড়তে। তবে উচ্চ ট্যাক্সের কারণে এসব বিদেশি শুঁটকির প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন অনেক ক্রেতা।

বর্তমানে আড়তে ৩০ থেকে ৫০ প্রজাতির শুঁটকি পাওয়া যায়। খুচরা ও পাইকারি ক্রেতারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে পছন্দের শুঁটকি কেনেন। বাজারে ফেসা, কইড়া, লটকি, বালিয়া, মিতি চকলেট, কাচকি, পাতা, চেলা ইত্যাদি শুঁটকি মাছ পাওয়া যায়। কেজিপ্রতি দামেরও রয়েছে বড় পার্থক্য—চেলা ৪০০-৭৫০ টাকা, কাচকি ৩২০-৫০০, ফেসা ৫০০-৭০০, ধঞ্চা ২০০-২৫০, লটকি ৫০০-১০০০, মিতি চকলেট ২০০-৪০০, বালিয়া ২০০-৩৫০ ও এলসি শুঁটকি ১৬০-১০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

দর্শনার একজন প্রবীণ শুঁটকি ব্যবসায়ী গণেশ দাশ বলেন, “এখানে একসময় অনেক ব্যবসায়ী ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেকে ঋণে জর্জরিত হয়ে ব্যবসা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। আমার পাশের এক ব্যবসায়ী জমি বিক্রি করে ঋণ শোধ করে এলাকা ছেড়েছেন।”

আরেক ব্যবসায়ী মনজুর আলম জানান, “দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে শুঁটকির সঙ্গে জড়িত। আগে প্রতিদিন ১-১.৫ লাখ টাকার শুঁটকি বিক্রি করতাম, এখন তা কমে এসেছে ৬০-৭০ হাজার টাকায়। চারজন শ্রমিকের বেতন দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ মেলে না। যদি সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা থাকত, তাহলে অনেকেই আবার ব্যবসায় ফিরে আসতেন।”

বিশ্লেষকদের মতে, রংপুরের এই শুঁটকি আড়ৎ শুধু একটি ব্যবসাকেন্দ্র নয়, এটি স্থানীয় অর্থনীতি এবং কর্মসংস্থানের জন্য এক বড় ভিত্তি। যথাযথ সহায়তা পেলে এই ঐতিহ্যবাহী হাট আবারও প্রাণ ফিরে পেতে পারে।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Tumblr
Telegram

বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

১ thought on “ঋণের বোঝা, ক্রেতার সংকট: হুমকিতে রংপুরের শুঁটকি আড়ৎ”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

যায়যায়কাল এর সর্বশেষ সংবাদ