জিয়াউল হক (খোকন), নিজেস্ব প্রতিবেদক: কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় তিন দিনব্যাপী লালন স্মরণোৎসব রাতে শেষ হয়েছে। পহেলা কার্তিক লালন তিরোধান দিবসে আবার একত্র হওয়ার প্রত্যয় নিয়ে সাধুগুরুরা অনেকেই ফিরে যেতে শুরু করেছেন নিজ নিজ গন্তব্যই।
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি পাখি কেমনে আসে যায় তারে ধরতে পারলে মন বেরি দিতাম পাখির পায় দিনাজপুরের প্রবীণ বাউল হেকমত আলী একতারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিকেলে একমনে গাইছিলেন লালন সাঁইয়ের এই গান। লালন স্মরণোৎসবের বিদায়ঘণ্টা বাজার মুহূর্তে এই গান যেন তবে তার কণ্ঠে হাহাকার হয়ে বাজছিল। ঢাকা গাজীপুর থেকে আসা প্রবীণ বাউল আসলাম ফকিরের কাছে বিদায়বেলার অনুভূতি জানতে চাইলে বলেন, সাঁইজির চরণতলে কটা দিন পড়ে ছিলাম। এখন বিদায়ঘণ্টা বেজে গেছে, কিন্তু মন তো চাইছে না বাড়ি ফিরতে।
কুষ্টিয়া ভেড়ামারা থেকে বাঁশি বিক্রি করতে এসেছে মেলার প্রাঙ্গনে মোহাম্মদ ভান্ডারী জানান, বেচাকেনার এবার খুব একটা বেশি ভালো হয়নি। এদিকে এবার শবে বরাতের কারণে দুদিন এগিয়ে আনা হয়েছে অনুষ্ঠানমালা। এবারের লালন স্মরণোৎসবের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।
তিন দিনব্যাপী এ উৎসবকে ঘিরে যেন মানুষের ঢল নেমেছিল লালনের আখড়া বাড়িতে। উৎসবকে ঘিরে সাধু ও দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত সাঁইজির ধাম। পরিবার পরিজনসহ অনেক দর্শনার্থী আসেছিলেন ছেঁউড়িয়ায়। মরমি সাধক ফকির লালন সাঁইজি জীবদ্দসায় শিষ্যদের নিয়ে দোল পূর্ণিমায় ছেঁউড়িয়ার কালীগঙ্গা নদীর তীরে সারা রাত ধরে তত্ব কথা আলোচনা ও গান বাজনা করতেন। বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের তিন দিনব্যাপী স্মরণোৎসবকে ঘিরে লালনের আখড়া বাড়িতে সাধু-ভক্তদের পদচারণায় মুখরিত ছিল
উল্লেখ্য, ১২৯৭ বঙ্গাব্দের পহেলা কার্তিক উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী সাধক বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ’র মৃত্যুর পর থেকে তার স্মরণে লালন একাডেমি ও জেলা প্রশাসন এই লালন স্মরণোৎসব চালিয়ে আসছে। কুষ্টিয়া শহরের কোল ঘেষে কুমারখালী উপজেলার কালীগঙ্গা নদী। এ নদীর তীরেই ছেঁউড়িয়ার লালন সমাধি। বাংলা ১২৯৭’র পহেলা কার্তিক ও ইংরেজী ১৭ অক্টোবর ১৮৯০ সালে এখানেই মরমী সাধক লালন শাহ’র শেষ শয্যা রচিত হয়।
গবেষকদের মতে, বাউল সাধক ফকির লালন শাহ’র জীবদ্দশায় দোল পুর্ণিমা উপলক্ষে পালন করা হতো দোল উৎসব। আর দোল পুর্ণিমাকে ঘিরেই বসতো সাধু সংঘ লালনের সেই স্মৃতির ধারাবাহিকতায় লালন একাডেমীও প্রতিবছর এ উৎসবটিকে ‘লালন স্মরণোৎসব’ হিসাবে পালন করে আসছে। তবে লালন অনুসারীরা দিনটিকে ‘দোল পূর্ণিমা’ উৎসব হিসাবেই পালন করে থাকেন। সাধুদের মতে, সত্যিকার অর্থে লালন অনুসারীরা দোল পূর্ণিমার এ রাতটির জন্য সারা বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন। সাঁইজির রীতি অনুসারে দোলপুর্ণিমার রাতের বিকেলে অধিবাসের মধ্য দিয়ে ২৪ ঘণ্টার দোলসঙ্গ শুরু হয়।
চৈত্রের পূর্ণিমা রাতে জ্যোৎস্নার ছটায় আর মাতাল হাওয়ায় গানে গানে বাউল সাধকরা হারিয়ে যায় ভিন্ন কোনো জগতে। পরের দিন চারটায় ‘পুণ্যসেবা’ দিয়ে সাধুসঙ্গ শেষ করে আখড়াবাড়ি ত্যাগ করেন বেশির ভাগ সাধু। দেশ বিদেশ থেকে আসা অনেক সাধু আরো দুদিন থাকেন, তারা মনে করেন, মানবধর্মই বড় ধর্ম। একসাথে এভাবে সাধুসঙ্গ করলে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। সাধু-গুরুর কৃপা ছাড়া মানুষ মুক্তি পেতে পারে না। তার কৃপায় মানুষ সঠিক পথ দেখে। মাজারের খাদেম মোহাম্মদ আলী শাহের তথ্য অনুসারে জানা গেছে, কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার ছেঁউড়িয়া গ্রামের এই আখড়াতেই ছিল ফকির লালন সাঁইজির প্রধান অবস্থান এবং এখানেই তার প্রয়াণ হয়। বর্তমানে এখানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে এবং গড়ে উঠেছে লালন একাডেমির।
এখানে ১৯৬২ সালে সমাধিসৌধ নির্মিত হয়েছে। এবারও পথপ্রদর্শক লালনকে স্মরণ ও অবাধ্য মনকে শুদ্ধ করতে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার লালন অনুসারী, ভক্ত-অনুরাগী আর দর্শনার্থীরা এই আখড়াবাড়িতে অবস্থান নিয়েছিলেন। রীতি অনুযায়ী সোমবার সন্ধ্যায় অধিবাস, পরদিন সকালে বাল্য ও দুপুরে পূর্ণ সেবার মধ্য দিয়ে সাধু সঙ্গ শেষ করে অনুসারীরা। ঐতিহাসিক এই উৎসবকে নির্বিঘ্ন করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছিল কয়েকস্তরের কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।