
পারভেজ আলম আদেল, স্টাফ রিপোর্টার: কোরবানির ঈদ মানেই গরুর হাট, কোরবানির প্রস্তুতি, আরেকটা ব্যস্ততা যেটা চোখের আড়ালে থেকে যায়— তা হলো দা, ছুরি তৈরির মহোৎসব।
পূর্বপুরুষের পেশাকে ঘিরে এখনো জ্বলছে আগুন, বাজছে হাতুড়ি, গড়ছে ঐতিহ্য সেই ব্যস্ততা এখন উপচে পড়ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার ঐতিহ্যবাহী কামারপাড়ায়। গ্রামের বাতাসে এখন বারুদের গন্ধ নেই, তবে আছে লোহার তাপ, আগুনের লালচে ঝলকানি আর হাতুড়ির ঘনঘন শব্দ—যা জানান দিচ্ছে, ঈদ আসছে।
দিন-রাত এক করে এখানে ছুরি, চাপাতি, বটি, দা—সব ধরণের কোরবানির অস্ত্র তৈরিতে মগ্ন কামাররা। কাঁধে ঘাম, হাতে ধরা হাতুড়ি, চোখে জ্বলন্ত আগুনের প্রতিচ্ছবি—তাদের এই যুদ্ধ যেন এক পবিত্র প্রস্তুতির অংশ।
যুগ বদলেছে, মানুষ বদলেছে, এমনকি অনেকেই পেশাও বদলে ফেলেছেন। কামারপাড়ার অনেকে এখন প্রবাসে, কেউ কেউ চালাচ্ছেন মুদি দোকান, কেউ বা রাইড শেয়ারিং সার্ভিসে ব্যস্ত। তবুও কিছু পরিবার এখনো আগুনের সঙ্গে বসবাস করে, লোহার গন্ধ মেখে বাঁচে, কারণ তাদের রক্তে মিশে আছে পূর্বপুরুষের সেই ঐতিহ্য।
৭০ বছরের বৃদ্ধ কামার শ্যামল চৌধুরী বলেন, “এই পেশা ছাড়তে পারিনি। অনেক কিছু শিখেছি, বুঝেছি, কিন্তু কামারের হাতুড়ির আওয়াজ ছাড়া আমার ঈদের আমেজই আসে না।”
তার মতোই ছেলেরাও এখন বাবার হাতের শিল্পকে ধরে রাখছে। কেউ কেউ অনলাইন অর্ডার নিচ্ছে, কেউ আবার নিজেই তৈরি করছেন ব্র্যান্ড। এই বদলটা শুধু সময়ের সঙ্গে তাল মেলানো নয়, বরং এক অনন্য ধারার উদাহরণ।
ঈদের ঠিক এক মাস আগে থেকেই শুরু হয় এই লৌহশিল্পের কোরবানির যুদ্ধ। দিনে ১২-১৬ ঘণ্টা কাজ করেন কামাররা। আগুনের ভেতর দিয়ে পুড়িয়ে ধাতুকে করে তোলা হয় ধারালো, নির্ভুল অস্ত্র—যা ঈদের কোরবানিতে গরু বা উট জবাইয়ের সময় একমাত্র ভরসা।
তরুণ কামার রতন বলেন, “আমরা ছুরি বানাই শুধু না, বানাই এক একটা আস্থা। আমাদের তৈরি জিনিসে কোরবানি সহজ হয়—এই কথা শুনলেই পরিশ্রম সার্থক মনে হয়।”
লোহা ও কয়লার দাম বেড়েছে, বিদ্যুৎ যায় আসে, আধুনিক যন্ত্রপাতির প্রতিযোগিতাও রয়েছে। কিন্তু কামাররা জানেন, তাঁরা এক ধরণের শিল্পী—যাঁরা আগুন দিয়ে শিল্প আঁকেন। তাই প্রতিকূলতা থাকলেও তাঁরা পিছু হটেন না।
তাদের চোখে ঈদ শুধু একটা উৎসব নয়, এটা কামারের শিল্পের নবজন্ম। কোরবানির পশুর রক্ত ঝরার আগেই কামারদের শরীর থেকে ঝরে পড়ে অগণিত ঘাম, যা বলে দেয়—এ উৎসব তাদেরও।
আমরা ঈদের দিন পরিচ্ছন্ন জামা পড়ে যখন হাসিমুখে কোরবানির প্রস্তুতি নিই, তখন একটু থেমে যদি ভাবি—যে ছুরির ধার দিয়ে কাজটি সম্ভব হচ্ছে, সেটি কার হাতে তৈরি? সেই ছুরি, সেই চাপাতি, সেই দা— সবই তৈরি হয়েছে এই সরাইলের কামারপাড়ায়, দিনের পর দিন, রাত জেগে, গায়ে আগুনের উত্তাপ নিয়ে।
তারা প্রচার চান না, তারা শুধু চান সম্মান আর টিকে থাকার সাহস। কারণ কামারশিল্প শুধু একটি পেশা নয়, এটা একটি চলমান জীবনধারা—যা ধ্বংস না করে আমাদের উচিত তাকে সমর্থন করা, উৎসাহ দেওয়া।