
মুহা. মনজুরুল ইসলাম: জাতীয় প্রেস ক্লাবে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হল মিলনায়তনে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ গ্রহণের ইতিকর্তব্য সম্পর্কে জ্ঞানভিত্তিক সামাজিক আন্দোলনের ‘ঢাকা ঘোষণা’ প্রদান করা হয়।
শনিবার (২৭ আগস্ট) উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিক্স এন্ড মেকাট্রোনিক্সদ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান ড. শামীম আহমেদ দেওয়ান। বিশেষজ্ঞ আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন ইঞ্জিনিয়ার ওমর ফারুক খোন্দকার, আঞ্চলিক পরিচালক, দক্ষিণ-প‚র্ব এশিয়া, সোভারিন সিকিউর, ইউ কে এবং বিটাক পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মুহসিন। প্রধান অতিথিকে বরণ করেন এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ঢাকা ঘোষণা পাঠ করেন জ্ঞানভিত্তিক সামাজিক আন্দোলনের সভাপতি এম এ বার্ণিক।
এসময় বক্তারা চ্যালেঞ্জ গ্রহণে ইতিকর্তব্য সম্পর্কে আলোচনায় বলেন, প্রথম শিল্প বিপ্লব ১৭৮৪ সালে, দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব ১৮৭০ সালে, তৃতীয় শিল্প বিপ্লব ১৯৬৯ সালে এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ২০১৬ সালে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সফলতা অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করবে এই ‘জ্ঞানভিত্তিক সামাজিক আন্দোলন’। আগামী ১০ বৎসরের মধ্যে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সফলতা বয়ে আসবে বলে জানান।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ গ্রহণের ২৫ দফা ঘোষণা-
০১. যেহেতু চতুর্থ শিল্পবিপ্লব (4IR) সমগ্রবিশ্ব ব্যবস্থাকে প্রযুক্তির মাধ্যমে যান্ত্রিক সভ্যতায় রূপদান করে চলেছে। সব কাজেই Automation-এর আওতায় এসে যাচ্ছে। মানুষের সাহায্য ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবেযন্ত্র কাজকরছে। মানুষযন্ত্রকে কন্ট্রোল করছে। যিনি যন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণের কৌশল জানবেন, তিনি টিকে থাকবেন। যিনি তা পরবেন না, তিনি অনিবার্যভাবে পেশা থেকে ঝরে পড়তে হবে। সেহেতু প্রতিটি প্রতিষ্ঠান সেখানে কর্মরতদের UP-Skill করে কিভাবে খাপ খাইয়ে নেয়া যায়, সেই পরি কল্পনা গ্রহণ করতে হবে। আর যারা তা পারবেন না, তাদের জন্য বিকল্প কর্ম সংস্থান সৃষ্টির ব্যবস্থা করতে হবে।
০২. চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল পেতে আমাদের ৩টি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতে হবে, (১) মানবসম্পদ উন্নয়ন, (২) সরকারের ডিজিটাল রূপান্তর বা ডিজিটাল সরকার, (৩) ডিজিটাল সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুযোগ কাজে লাগাতে হলে আমাদের প্রধানতম লক্ষ্য হবে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী সুদক্ষ মানব সম্পদ সৃষ্টি। আর এজন্যে প্রয়োজন হবে শিক্ষা-ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন অর্থ্যাৎ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রযুক্তি নির্ভর হিসাবে ঢেলে সাজাতে হবে। তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, ইন্টারনেট ও অন্যান্য প্রযুুক্তির মাধ্যমে অব্যাহত যোগযোগ রক্ষা করতে হবে। নিয়মিত প্রযুক্তির যন্ত্রগুলো আপডেট করার পাশাপাশি প্রযুক্তির নিরাপত্তা ঝুঁকি আপডেটের সাথে সমন্বয় সাধনের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
০৩. জাতীয় পর্যায়ে প্রযুক্তিগত অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব পুরো জীবন ব্যবস্থাকে যথা প্রযুক্তির সঙ্গে মানুষ, প্রকৃতি ও সমাজের সম্পর্ক বৃহত্তর রূপান্তর হতে পারে। তাই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য আমাদের প্রস্তুতি থাকতে হবে। শিল্প কারখানায় যে পরিমাণ কাজের সুযোগ নষ্ট হবে, তার চেয়ে অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বিগ ডাটা, ডাটা এনালিটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অটোমেশনের সমন্বিত ব্যবহার করতে দ্রুত কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
০৪. চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের নেতিবাচক দিক মোকাবেলা করে এটির সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য নীতি ও শাসন পদ্ধতিতে উদ্ভাবনমূলক অভিনব পদ্ধতি ডিজাইন এবং ব্যবহার চালু করার জন্য সরকার বড় বড় কোম্পানি, নাগরিক সমাজ, যুব সমাজ, উদ্যোক্তা, রাজনীতিবিদ, নবীন উদ্দ্যোগ (Start-up) এবং সমাজের সর্বস্তরে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। সম্মিলিত কাজের জন্য একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা যেতে পারে।
০৫. Artificial Intelligence-এর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো প্রাথমিক অবস্থানেও নেই। শিল্প ও পরিষেবার সমস্ত সেক্টরে Artificial Intelligence বিপ্লবে যোগ না দিলে যে-কোন দেশের বড় ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেদের সুবিধার্থে Artificial Intelligence সক্ষম সিস্টেম পরিষেবাগুলোর দ্বারা প্রদত্ত ক্ষমতার অপব্যবহার হতে পারে। তারপরও প্রযুক্তি ও সভ্যতাকে পাশ কাটিয়ে থাকা যাবে না। Artificial Intelligence-এর সভ্যতায় পৌছাবার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রকল্প গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। সে লক্ষ্য অর্জনে দেশে Artificial Intelligence Centre প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এ প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনসম্পদ গড়ে তুলতে হবে। এক বিংশ শতাব্দীতে ডিজিটাল রূপান্তরে কিভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে, তা অনুধাবন করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে আলোচ্য প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
০৬. শিল্পক্ষেত্রে রোবটিক্স কিংবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বহুল ব্যবহারের কারণে জনশক্তির প্রয়োজনীয়তা অনেকাংশে হ্রাস পাবে। ফলে ব্যপক সংখ্যক মানুষের পেশা পরিবর্তন অথবা দক্ষতা উন্নয়ন প্রয়োজন হবে। পেশার পরিবর্তন কিংবা দক্ষতা উন্নয়নের জন্য একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা থাকা দরকার। সেই পরিকল্পনাটি গ্রহণ করতে হবে সময়োপযোগী দক্ষ লোক গড়ে তোলার প্রয়োজনে।বছরে কোন কোন সেক্টরে কত জন দক্ষ লোক তৈরি করা হবে, তা পরিকল্পনার মধ্যে থাকা বাঞ্ছনীয়।
০৭. চতুর্থ শিল্পকে বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে যে-কোন শিল্পের ব্যবসা শুরু করার জন্য প্রাথমিক বিনিয়োগের পরিমাপ অনেক বৃদ্ধি পাবে। ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিবে। তাই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে সময়োপযোগী রূপে গড়ে তোলার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করতে হবে। সেজন্য এ ধরনের শিল্পের সংখ্যা নির্ধারণ করে সেগুলোর জন্য আলাদাভাবে প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে।
০৮. সাইবার সিকিউরিটির দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারনে বাংলাদেশ-সহ অনেক দেশ ফিনেশিয়াল ট্রানজেকশন নাজুক আবস্থান রয়েছে।ফলে ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন করার সময় প্রায়ই বিপুল পরিমাণ টাকা লোপট হয়ে যাচ্ছে। বিদেশে লোপট হওয়া অর্থ মামলা দিয়েও ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না।
মোবাইল ব্যাংকিং এবং ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবায় বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে গেলেও হ্যাকিং প্রতিরোধ কৌশলে পিছিয়ে আছে। বিকাশ, নগদ, উপায় প্রভৃতি মাধ্যমে অর্থ লেনদেন অথবা মোবাইল ফোনে কোন কারণে একজনের টাকা আরেক জনের কাছে চলে গেলে সেই টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হয় না।
ডিজিটাল পদ্ধতিতে হ্যাকিং করে টাকা চুরির টেকনিক রোধের সিস্টেম এখনো বাংলাদেশে নেই, আইনি কাঠামোও তৈরি হয়নি। অথচ বাংলাদেশের অনেক বিশেষজ্ঞ বিদেশে সাইবার সিকিউরিটি ম্যানেজমেন্টে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়। তাই এক্ষেত্রে একদিকে নতুন আইন প্রণনয় এবং অন্যদিকে চৌকষ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগানোর পরামর্শ দেয়া যায়।
০৯. প্রধানমন্ত্রীর র্কাযালয়রে অধীনে National Skills Development Authority (NSDA) রয়ছে। সাইবার সিকিউরিটি ম্যানেজমেন্টের উপর দক্ষ নাগরিক গড়ে তোলার লক্ষ্যে NSDA-এর অধীনে একটি‘ ডিজিটাল সাইবার সিকিউরিটি অ্যাকাডেমি’ (DCSA)-প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।
১০. National Security এবং দেশের Defence System সুরক্ষিত রাখার ক্ষেত্রে Cyber Security অনেক জরুরি। কারণ Defence System অটোমেশন হওয়ার সাথে সাথে সেখানা কার গোপনীয় ডাটাগুলো হ্যাকারেরা হানা দিয়ে অজান্তেই তথ্য চুরি করার সুযোগ রয়েছে। তাই যে-কোন দেশ প্রতিরক্ষার সার্ভিসে উচ্চ মাপের সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ দেয়া বাঞ্ছনীয়। তবে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের প্রতিরক্ষার সার্ভিসের সাইবার সিস্টেমে প্রবেশের অনুমতি দান বিপজ্জনক।
নেটওয়ার্কের Incoming এবং Outgoing traffic-এর নজর রাখা এবং নেটওয়ার্কের মধ্যে চালে আসা যে-কোন ধরনের attack এবং threat-সমূহ বাধা দিয়ে থামিয়ে দেয়ার ওয়াল তৈরির আগে Defence Service পরিপূর্ণ অটোমেশনে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ বটে।
১১. স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থা এখানে চতুর্থ শিল্পকে বিপ্লবের ছাপ নেই। শিল্প বিপ্লবের উপযোগী শিক্ষায় ৪টি ধাপ রয়েছে-(১) লেকচার মেমোরাইজেশন, (২) নজেল প্রডিউসিং এডুকেশন, (৩) ইন্টারনেট ইনেবলড লার্নিং, (৪) ইনোভেশন প্রডিউসিং এডুকেশন। সেজন্যে শ্রেণি কক্ষগুলো প্রযুক্তি শিক্ষার উপযোগী করা এবং কারিকুলাম নতুনভাবে বিন্যাস করা দরকার। ন্যানোটেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-সহ প্রযুক্তির নানা বিষয় শিক্ষা কারিকুলামে সংযুক্ত করতে হবে।
১২. বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বিষয়ক গবেষণা ও উদ্ভাবনমূলক কার্যক্রম বাড়াতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিল্পক্ষেত্রের মধ্যে সমন্বয় সাধনের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে করে নতুন নতুন প্রযুক্তির উপযোগী শিক্ষা ও শিল্প Adaptable হয়। শিল্প কারখানায় চতুর্থ শিল্প বিল্পবের সুবিধা কাজে লাগতে প্রযুক্তিগুলোর ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে।
১৩. প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ উদ্যোগে নিজস্ব কর্মীদের পেশা ধরে রাখা স্বার্থে Action Research শুরু করতে হবে। কত সংখ্যক কর্মীদের Re-skill -এর মাধ্যমে Adapted করা যায়, আর কত সংখ্যককে Adapted করা যায় না, তা আলোচ্য গবেষণার দ্বারা নির্ধারণ করা বাঞ্ছনীয়।
১৪. যেহেতু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিপুল জন গোষ্ঠী হঠাৎ করে কর্মহীন হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেহেতু জনশক্তি রফতানির প্রক্রিয়াটি ব্যাহত হয়ে পড়বে। বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে প্রশিক্ষণ দিয়ে কিভাবে 4IR-এ উপযোগী দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা সম্ভব, সেই কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা সময়ের দাবি।
১৫. টেকনোলজিতে এগিয়ে থাকার পরও চীন বিদেশ থেকে বড় বড় গবেষকদের বেশি পারিতোষিক দিয়ে সেদেশে কাজ করার জন্য Thousand Scholars Scheme হাতে নিতে দেখা যায়। IT Sector-এ সমৃদ্ধ জাপান অন্য দেশের আইটি বিশেষ্ণদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে নিজ দেশকে আরও সমৃদ্ধ করতে দেখা যায়। পিছিয়ে পড়া দেশগুলো মেধাবিদের মেধাকে নিজ নিজ দেশে কাজে লাগাবার লক্ষ্যে এসব দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে।
১৬. নিজের বুদ্ধিমত্তাকে যন্ত্রে প্রবাহিত করে মানুষ পেছনে থেকে যন্ত্রকে পরিচালনা করছে। কিন্তু সে পেছনের দিকে চলে যেতে পারে না। মানুষের ব্রেইনের কাজটা রোবটে সঞ্চারিত হচ্ছে। মানুষের মধ্যে হার্ড-কপি বই, পত্রিকা ও হাতে-কলমে গবেষণা করার কাজটি থেকে দূরে সরে আসার মানসিকতা প্রবল হচ্ছে। এটা একটা অশনি সংকেত। বরং রোবট থেকে শিক্ষা নিয়ে জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে সেটার প্রয়োগ অনস্বীকার্য।
১৭. ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের ছোঁয়ায় যে যান্ত্রিক সভ্যতার সৃষ্টি হচ্ছে, সেটার বিকিরণগত বর্জ্য মানুষের বসবাসযোগ্য পৃথিবীর জন্য নতুন সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশ ও প্রতিবেশের বিপর্যয় ঘটতে শুরু করেছে। তাই টেকনোলজির নতুন নতুন সংযোগ পরিবেশ বান্ধব করার জন্য সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের গুরুত্ব দিতে হবে। যেখানে পরিবেশ রক্ষার ডিভাইসগুলো সংযোজন দরকার, সেখানে তা সংযোজন করার ক্ষেত্রে আইনগত বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে হবে।
১৮. বর্তমানে প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে যে National Skills Development Authority (NSDA) রয়েছে, সেটির সাথে 4IR বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপটে National Action Research Centre(NARC) প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এ প্রতিষ্ঠান সরকারি ও বেসরকারী যাবতীয় পেশাজীবীদের কর্মভিত্তিক প্রাতিষ্ঠানিক ডাটাবেজ তৈরির পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। NARC প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ডাটাবেজ তৈরির কার্যক্রম শুরু করতে উদ্বুদ্ধ করবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের/সংগঠনের নিজ নিজ পেশাজীবীদের ডাটাবেজ তৈরিতে সহযোগিতা করবে। প্রস্তুতকৃত ডাটাবেজ কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করবে। ভিন্নভিন্নভাবে সকল প্রতিষ্ঠানের ডাটাবেজ পর্যালোচনা করে স্বকল্প ও বিকল্প কর্মসংস্থানের নির্দেশনা/সুপারিশমালা প্রদান করবে। জ্ঞানভিত্তিক সামাজিক আন্দোলন (KBSM) সর্বাবস্থায় প্রস্তাবিত NARC-কে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সহযোগিতা করবে।
১৯. Internet of Things (IOT) ব্যবহারিক প্রয়োগের জন্য সরকার ইতোমধ্যে একটি ল্যাব প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এটি পুরোপুরি প্রাথমিক চিন্তা বলা চলে। বিশ্বে ম্যানুফ্যাকচারিং, মেডিকেল সার্ভিস, রুম অটোসেশন, ট্রান্সপরটেশন, সিকিউরিটি, ডিজিটালশহর তৈরির ক্ষেত্রে, এমন কি শিক্ষাক্ষেত্রে IOT-এর ব্যবহার শুরু হয়েছে। আইওটি ডিভাইসগুলো হ্যাকারদের কবলে পড়তে পারে। ডিডসঅ্যাটাক, ওয়ার্ম অ্যার্টকে, ভয়েজ ও সাউন্ডঅ্যাটাক রোধে এন্টি-ডিডস ব্যবহার ও কিছু সফটওয়্যার রয়েছে। একটি রুম কিং বা একটি শহরকে IOT-এর আওতায় আনার সময় প্রটেকশন সিস্টেম সংযুক্ত করা বাঞ্ছনীয়।
২০. জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (জিনতত্ত্ব প্রকৌশল)ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ব্যপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। নতুন নতুন ফসলের জাত উদ্ভাবন, মাছের নতুন নতুন জাত তৈরিসহ কৃষি ও প্রাণিবিদ্যার শিক্ষায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আলোচ্য বিষয়টি গুরুত্বের সাথে শেখানো হচ্ছে। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে পাট ও এর পরজীবী ছত্রাকের জিন নকশা আবিষ্কার করেছেন। জীবন রক্ষাকারী ঔষুধ উৎপাদন, এনজাইম ও হরমোন উৎপাদনে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং আবদান অনেক। ইতোমধ্য বাংলাদেশে বায়োটেক ড্রাগ উৎপাদনে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নতুন প্রচেষ্টার শুরু হয়েছে। এই সম্ভাবনাময় বিজ্ঞানের দ্রুত প্রসার ঘটাতে পারলে বাংলাদেশ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের একটা সুবিধাজনক স্থান করে নিতে সক্ষম হবে।
২১. চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে Nanotechnology ব্যবহার করে স্থায়ী মজবুত ও টেকসই পণ্য তৈরি হয়। ব্যাটারি, ফুয়েল সেল, সৌরশক্তিকে অধিকতর কাজে লাগাতে আলোচ্য প্রযুক্তির ব্যবহার লক্ষণীয়। রোবট তৈরি, প্লাজমা ডিসপ্লে, মহাকাশ যন্ত্রপাতি উৎপাদনে ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহার হয়। প্রযুক্তিটি ব্যয় বহুল এবং মানুষের শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর হলেও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অগ্রযাত্রায় আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ বিষয়ে গবেষণা শুরু করা বাঞ্ছনীয় ।
২২. ক্রিপটোকারেন্সি সম্পর্কে উন্নত বিশ্বে একটি উত্তেজনাপূর্ণ বাতাস রয়েছে, প্রোগ্রামযোগ্য অর্থনীতি তৈরি করে ক্রিপটোকারেন্সিতে দৈনন্দিন জীবনের কোটি কোটি দিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশে এখানো এটি স্বীকৃত হয়নি। বিশ্ব অর্থনীতি ক্রিপটোকারেন্সির মাধ্যমে নতুন বিন্যাসের আভাস দেয়া আমরা বিষয়টি উপেক্ষা করেতে পারি না।
২৩. পরিধেয় প্রযুক্তি (Wearable Technology) –র মাধ্যমে প্রতিরক্ষামূলক পোশাক, অবস্থান ট্র্যাকিং, স্বাস্থ্যসেবা পরিধেয় ওয়েব চালু হতে যাচ্ছে। এসব পরিধেয় পণ্য হৃদস্পন্দন, ঘাম, তাপমাত্রা পরিবর্তন পেশির ক্রিয়াকলাপ ও দেহের প্রতিটি পরিবর্তন পরিমাপে সক্ষম হবে। ইতোমধ্যে সৌর চালিত পোশাক আবিস্কৃত হয়েছে। ফলে পোশাক শিল্পের বর্তমান ধারায় পুরোপুরি পরিবর্তন ঘটবে। আমাদের পোশাক রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বর্তমান ধারায়ও পরিবর্তন আসবে। তাই প্রযুক্তির পরিবর্তিত ধারাটির রপ্ত করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও বিশেষজ্ঞ তৈরির কাজে আমরা পিছিয়ে থাকতে পারি না।
২৪. সেন্সর, ক্যামেরা, রাডার ও AI সংমিশ্রণে অটোনোমাস যানবাহন তৈরি হচ্ছে। চালকবিহীন যানবাহনগুলোর জন্য নতুন নতুন সফটওয়্যার তৈরি হচ্ছে। এসব যানবাহনে সাইবার আক্রমণের ঝুঁকি আছে। অটোনোমাস যানবাহনের আগমনে পরিবহন সেক্টরে আমূল পরিবর্তন হবে। আমাদের বর্তমান গাড়ি চালক, হেলপার, কনট্রাকটর-সহপরিবহনের সাথে সংশ্লিষ্টদের পেশা থাকবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসব পরিবহনকর্মীদের বিকল্প কর্মসংস্থান পরিবহন সেক্টরেই করা যেতে পারে। সেজন্য পূর্ব-প্রস্তুতির দরকার। সর্বশেষ প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানের প্রশিক্ষণ দিয়ে যে কাজের জন্য যাকে উপযুক্ত রূপে গড়ে তোলা যায়, সে কাজে তাকে নিযুক্ত করা সম্ভব হতে পারে।
২৫. যান্ত্রিক সভ্যতার কাছে মানবিকতা হেরে যেতে পারে না। ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে একটা নীতিতে মানুষকে কাজ করতে হবে এবং সেটি হলো, “ প্রথমে আমরা মানুষ, মানুষের প্রয়োজনে যন্ত্র, আর যন্ত্রের কাজ হবে মানবতার কল্যাণ”।
উক্ত ২৫টি পয়েন্টের বাস্তবায়ন, বিশ্ববাসীর অগ্রযাত্রার শুভ পথকে সুশোভিত করতে পারে।