বৃহস্পতিবার, ১১ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ,২৪শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

এর সর্বশেষ সংবাদ

ডলার ১১৭ টাকার প্রভাব কী হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক : সুদহার নির্ধারণের সব ধরনের কলাকৌশল তুলে দিয়ে তা ‘বাজারভিত্তিক’ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মাধ্যমে নিজেদের সুবিধামতো সুদহার নির্ধারণের অধিকার ফিরে পেয়েছে ব্যাংকগুলো। ফলে সব ধরনের ঋণের ওপর সুদের হার আপাতত আরও বেড়ে যাবে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার আরও বাড়ানো হয়েছে। বেড়েছে ডলারের দামও। নথিপত্রে এখন ডলারের দাম ১১০ টাকা হলেও তা একবারে বাড়িয়ে ১১৭ টাকা করা হয়েছে।

ঋণের সুদহার ‘সম্পূর্ণরূপে বাজারভিত্তিক’ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার নির্ধারণের সর্বশেষ পদ্ধতি স্মার্ট বিলুপ্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। ৯ মাস ধরে চালু ছিল স্মার্ট বা ‘সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল’ভিত্তিক সুদ নির্ধারণ। ২০২০ সালের এপ্রিলের আগে ব্যাংকঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক ছিল। তবে এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে এই হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে বেঁধে দিয়েছিল।

ডলারের দাম একবারে ৭ টাকা বাড়ানো হয়েছে বিনিময় হার নির্ধারণের ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর অংশ হিসেবে। এর আগে দেশে ডলারের দাম কখনো একসঙ্গে এতটা বাড়েনি। ফলে আরও চাপ তৈরি হতে পারে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দামের ওপর। কারণ, ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত দরে ডলার কিনলেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মতো পণ্য আমদানিতে এত দিন ১১০ টাকা দামে ডলার দিত বাংলাদেশ ব্যাংক।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে অনেকটা তড়িঘড়ি করে বুধবার আর্থিক খাতের এসব সিদ্ধান্ত জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আইএমএফের যে প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশ সফর করছিল, তারা গতকালই তাদের মিশন শেষ করেছে। এসব সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে বাংলাদেশ ব্যাংক সংবাদ সম্মেলন ডাকলেও তাতে অংশ নেননি সাংবাদিকেরা। দেড় মাস ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে না দেওয়ার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন বর্জন করেন সব সাংবাদিক।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘদিন ধরে সংকোচনমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে অর্থনীতিবিদেরা আহ্বান জানালেও তাতে সাড়া দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে আইএমএফের ঋণের শর্ত মেনে এবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব পদক্ষেপ নিয়েছে। এ নিয়ে গতকাল একাধিক প্রজ্ঞাপন জারির পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) ডেকে কিছু পরামর্শ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। তাদের বলা হয়েছে, সুদহার বাজারভিত্তিক করা হলেও তা বর্তমানের চেয়ে ১ শতাংশের বেশি যেন না বাড়ে। আর ডলারের মধ্যবর্তী দাম ১১৭ টাকার আশপাশে রাখতে বলা হলেও তা যেন ১১৮ টাকার মধ্যে লেনদেন হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেওয়া পদক্ষেপের প্রভাব সম্পর্কে বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ডলার এখন ১১৭-১১৮ টাকার মধ্যে লেনদেন হচ্ছে। সুদহার ইতিমধ্যে বেশ বেড়ে গেছে। সর্বোচ্চ সুদ সাড়ে ১৩ শতাংশ হলেও আমরা ১১-১২ শতাংশের মধ্যে ঋণ দিচ্ছি। ফলে খুব বেশি প্রভাব বাজারের ওপর পড়বে না। তবে জ্বালানি ও সার আমদানির জন্য কম দামে ডলার বিক্রি করে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব পণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে যাবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল পৃথক দুই প্রজ্ঞাপনে সুদহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। একটির মাধ্যমে চলমান স্মার্ট পদ্ধতি প্রত্যাহার করা হয়েছে। আরেকটির মাধ্যমে ব্যাংকঋণের সুদহার সম্পূর্ণ বাজারভিত্তিক করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে। সবশেষ ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলো ঋণের খাতভিত্তিক সুদের হার ঘোষণা করবে এবং তুলনামূলক ঝুঁকি বিবেচনায় গ্রাহক ভেদে ঘোষিত হারের চেয়ে ১ শতাংশ কম বা বেশি হারে ঋণ বিতরণ করতে পারবে। মঞ্জুরিপত্রে ঋণের সুদহার অপরিবর্তনশীল না পরিবর্তনশীল, তা উল্লেখ থাকতে হবে। কোনো ঋণের সুদহার পরিবর্তনশীল হলে তা বছরে সর্বোচ্চ কতবার বৃদ্ধি করা হবে এবং কত শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, তা অবশ্যই মঞ্জুরিপত্রে উল্লেখ করতে হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, কোনো ঋণ অথবা ঋণের কিস্তি সম্পূর্ণ বা আংশিক মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হলে যে সময়ের জন্য মেয়াদোত্তীর্ণ হবে, সেই সময়ে চলমান ঋণ/তলবি ঋণের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ঋণস্থিতির ওপর এবং মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে মেয়াদোত্তীর্ণ কিস্তির ওপর সর্বোচ্চ দেড় শতাংশ দণ্ড সুদ আরোপ করা যাবে। ঘোষিত সুদহারের অতিরিক্ত কোনো সেবামাশুল আদায় করতে পারবে না ব্যাংকগুলো। এই প্রজ্ঞাপন জারির পর বুধবার কিছু ব্যাংক ঋণের সুদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানিয়ে গ্রাহকদের খুদে বার্তা দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক একই সঙ্গে নীতি সুদহার হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। মুদ্রানীতি কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নীতি সুদহার বিদ্যমান ৮ শতাংশ থেকে ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৫০ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি নীতি সুদের করিডরের ঊর্ধ্বসীমা এবং নিম্নসীমাও বাড়ানো হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, নীতি সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা স্ট্যান্ডিং ল্যান্ডিং ফ্যাসিলিটির (এসএলএফ) ক্ষেত্রে সুদহার ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বৃদ্ধি করে ১০ শতাংশে এবং নীতি সুদহার করিডরের নিম্নসীমা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বৃদ্ধি করে ৭ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়েছে। এসএলএফ হলো বিশেষ পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার নেওয়ার সুবিধা ও এসডিএফ হলো বাংলাদেশ ব্যাংক যে সুদে ব্যাংক থেকে টাকা নিতে পারে।

আলাদা এক প্রজ্ঞাপনে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালু করার কথা জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এই পদ্ধতি চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন করেছে। ক্রলিং পেগ পদ্ধতির আওতায় ডলারের মধ্যবর্তী একটি দাম নির্ধারণ করে ব্যাংকগুলোকে এই দরের আশপাশে স্বাধীনভাবে লেনদেন করতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মধ্যবর্তী এই দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা।

ব্যাংকাররা জানান, এখন ১১৭-১১৮ টাকার মধ্যে ডলার কেনাবেচা হচ্ছে। তবে নথিপত্রে ১১০ টাকা লেখা থাকে। নতুন ঘোষণায় বিদেশে থাকা অর্থ স্থানান্তর প্রতিষ্ঠানগুলো ডলারের দাম বাড়িয়ে দেবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়।

দুই বছর ধরে দেশে ডলারের সংকট চলছে। এ সময়ে ডলারের দাম ৮৫ থেকে বেড়ে ১১৭ টাকা হয়েছে। এর ফলে আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়েছে, মূল্যস্ফীতি বেড়ে দীর্ঘদিন ধরে ৯ শতাংশের ওপর অবস্থান করছে। তবে অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, ঋণের সুদ ও ডলারের দাম বাড়লে তা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সহায়তা করবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে পরামর্শ করে আমদানি ও রপ্তানি থেকে শুরু করে সাধারণ গ্রাহকের কাছে কত দরে ডলার কেনাবেচা করা হবে, এত দিন তা ঠিক করত বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Tumblr
Telegram

বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *