
খাইরুল হাসান, (নবীনগর) ব্রাহ্মণবাড়িয়া: চৌসার যুদ্ধে শের শাহের আক্রমণে ডুবতে বসা সম্রাট হুমায়ুনকে বাঁচিয়েছিলেন নিজাম নামের এক ভিস্তিওয়ালা। সম্রাট হুমায়ুন কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে ভিস্তিওয়ালকে ওয়াদা করেছিল তিনি ফিরে গিয়ে তাকে একদিনের সম্রাট বানাবেন। পরে সম্রাট ফিরে গিয়ে সত্যিই ভিস্তিওয়ালা নিজামকে ডেকে ওয়াদা অনুসারে একদিনের জন্য ভারতবর্ষের সম্রাট করেন।
ইতিহাসে উল্লেখিত এই ভিস্তিওয়ালাদের একসময় ঢাকার রাস্তায় হামেশাই দেখা যেত। কালের বিবর্তনে এই পেশার লোকরা হারিয়ে গেছেন।
উপমহাদেশে মোগলদের শাসনামলে বা তারও পরে, ব্রিটিশ আমলে দিল্লি বা কলকাতার মতো ঢাকায়ও চামড়ার মশকে পানি ভরে তা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতেন এই ভিস্তিওয়ালারা। তারা মশক কাঁধে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় পানি ফেরি করেও বেড়াতেন। ওই মশককে বলত ‘ভিস্তি’ আর যারা পানি বিলানোর কাজ করতেন তাদের বলা হত ‘ভিস্তিওয়ালা’।
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ঢাকার রাস্তায় ভিস্তিদের আনাগোনা ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর ঢাকা শহরে ছিল সুপেয় পানির বেশ অভাব। ভারতবর্ষের অন্য অঞ্চলের মতোই ঢাকায়ও খাবার পানির জন্য নির্ভর করতে হতো খাল, নদী বা কুয়ার ওপর। তখন মিনারেল ওয়াটারের যুগ ছিল না। পশুর চামড়াই ছিল পানি সরবরাহের একমাত্র মাধ্যম।সেই চামড়ার থলেকে বলা হতো “মশক”। মীজানুর রহমানের ঢাকা পুরাণ থেকে জানা যায়,”সেকালে কলের পানি সব বাড়িতে পৌঁছায়নি।যেখানে পানির কল নাস্তি সেখানে ভিস্তিওয়ালা সহায়।দেখেছি ছাগলের চামড়ার মশকে করে পানি ফেরির দৃশ্য।”
ঢাকায় ভিস্তিওয়ালাদের “সাক্কা” বলা হত। ঢাকা পুরাণ থেকে আরো জানা যায় সেসময় ভিস্তিওয়ালাদের একটি সংগঠনও ছিল। সংগঠনের প্রধানকে নওয়াব ভিস্তি বলা হতো। আজ পুরান ঢাকার যে সিক্কাটুলি দেখা যায় তা ছিল ভিস্তিদের এলাকা। ১৮৩০ সালে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট হেনরি ওয়াল্টারস এক আদমশুমারিতে ১০টি ভিস্তিপল্লীর উল্লেখ করেছিলেন।
ইসলাম ধর্মাবলম্বী এসব ভিস্তিরা ছিল সুন্নি মুসলিম। মহররমের মিছিলে পানি ছিটিয়ে রাস্তা পরিষ্কার রাখার কাজে দেখা যেত তাদের। দ্য লাস্ট ওয়াটারম্যান খ্যাত বিশেষ এ পেশাজীবী শ্রেণির মধ্যে নিজস্ব পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।লালবাগ কেল্লায় ভিস্তিরা টমটম ভরে বড় বড় চামড়ার থলেতে পানি দিয়ে আসতো।
শামসুর রাহমান লিখেছেন,”আর বুলিনি সেই ভিস্তিকে,যে রোজ মশক ভরে দুবেলা পানি দিয়ে যেত আমাদের বাড়িতে।”
তিনি আরো বলেছেন- “কালো মোষের পেটের মত ফোলা ফোলা মশক পিঠে বয়ে আনত ভিস্তি। তারপর মশকের মুখ খুলে পানি ঢেলে দিত মাটি কিংবা পিতলের কলসির ভেতর৷ মনে আছে ওর থ্যাবড়া নাক, মাথায় কিস্তি টুপি, মিশমিশে কালো চাপদাড়ি আর কোমরে জড়ানো পানিভেজা গামছার কথা।”
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “তখন বেগে ছুটিল ঝাঁকে ঝাঁকে,/ মশক কাধে একুশ লাখ ভিস্তি।/ পুকুর বিলে রহিল শুধু পাঁক,/ নদীর জলে নাহিকো চলে ভিস্তি।”
সুকুমার রায় তাঁর “ন্যাড়া বেলতলায় ক’বার যায়?” ছড়ায় ভিস্তিদের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। “লাখোবার যায় যদি সে যাওয়া তার ঠেকায় কিসে?/ ভেবে তাই না পাই দিশে নাই কি কিচ্ছু উপায় তার?/ এ কথাটা যেমনি বলা রোগা এক ভিস্তিওলা ঢিপ্ ক’রে বাড়িয়ে গলা প্রণাম করল দুপায় তার।”
ঢাকায় ১৮৭৮ সালের আগ পর্যন্ত কোন নিরাপদ পানির স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ১৭৮৪ সালে ঢাকার কালেক্টর পানীয় জলের খরচ বাবদ পেতেন ১৫০ টাকা। যেখানে এক টাকায় দুমণ চাল পাওয়া যেত। এত টাকা পানীয় জলের পেছনে বরাদ্দের কারণ ছিল ঢাকার পানি স্বাস্থ্যসম্মত ছিল না। তার উপর সারা বছর চলতো কলেরার মহামারি। অভিজাত লোকজন সুদূর মেঘনা থেকে পানি আনতে পাঠাতো। নবাব আবদুল গনি ও নবাব আহসানউল্লাহর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ১৮৭৪ সালে চাঁদনীঘাটে স্থাপিত হয় ‘ওয়াটার-ওয়ার্কস’ পানি পরিশোধনাগার। তবে শুরুতে ঢাকাবাসীর জন্য সুপেয় পানির সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল খুবই অপ্রতুল। প্রথমদিকে চার মাইল এলাকাজুড়ে পানি সরবরাহের পাইপ বিস্তৃত ছিল। দৈনিক পানি সরবরাহের পরিমাণ ছিল ৩৫ হাজার গ্যালন। ১৮৭৯ সালে ঢাকার নওয়াব আব্দুল গণি “কেসিএসআই” উপাধি পান। তিনি তখন ঢাকার পানি সংস্থান প্রকল্পে লাখ টাকা দান করেন।
জিন্দাবাহার চৌধুরী বাড়ির জমিদারকন্যা আমেতুল খালেক বেগম ভিস্তিওয়ালাদের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে লিখেছেন, “সকাল বেলা ভিস্তি আসত বিরাট মশকে ভরে পানি কাঁধের ওপর ঝুলিয়ে। …ভিস্তির সেই বিকট গলা …‘ভিস্তি আবে ভিস্তি’। মশকের মুখটা খুলে চেপে ধরে কলসিতে পানি ঢেলে রাখত। বিরাট সেসব কলসি, মাটির মটকায়ও পানি রাখা হতো। মনে হয় এসব স্মৃতি ১৯৪১-৪২ সালের।”
ঢাকা শহরে ভিস্তিওয়ালারা বহুদিন যাবত তাদের পোক্ত অবস্থান ধরে রেখেছিলেন। ভারতবর্ষে ঢাকাই ছিল শেষ শহর যেখানে ষাটের দশক পর্যন্ত ভিস্তিওয়ালাদের দেখা যেত। ১৯৬৮ সালের দিকে এসে ঢাকা শহর থেকে তারা বিলুপ্ত হয়ে যায়। বর্তমানে পুরান ঢাকার সিক্কাটুলি দাঁড়িয়ে আছে ভিস্তিওয়ালা নামের অতীতের এক কর্মজীবীদের পেশার সাক্ষী হয়ে।