
বি এম বাবলুর রহমান, তালা: জন্ম থেকে সে বাক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হোসেন আলী সরদার (২৫)।
অন্যত্র চলে যাওয়ার ভয়ে তাকে প্রতিদিন বাড়ির পেছনে রাস্তার ধারে শিকলবন্দী করে রেখেছেন অসহায় পিতা-মাতা। বলছি তালা উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের শুকদেরপুর গ্রামের দিনমজুর মো. মালেক সরদারের বড় ছেলের কথা। এভাবে ১৮ বছর ধরে শিকলবন্দী জীবন কাটাচ্ছেন হোসেন আলী সরদার (২৫)।
সরেজমিনে দেখা গেছে, হোসেন আলীকে বাড়ির পেছনে রাস্তার ধারে শিকলবন্দী করে রাখা হয়েছে। পথচারীদের কাছে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে সে খাবার চায়। তার আকুতি দেখে অনেকেই তাকে খাবার কিনে দেন। পথচারীদের উপহার পেয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ে হোসেন আলী। শিকলবন্দী এই জীবন কত কষ্টকর সেটা তাকে দেখলে বোঝা যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হোসেন আলী প্রতিবন্ধী হলেও বাবা-মায়ের কাছে সে তাদের চোখের মণি। দরিদ্র পিতা-মাতা সাধ্যমতো যত্নে রাখার চেষ্টা করে তাকে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হোসেন আলীকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানোর কথা থাকলেও নির্যাতনের ভয়ে তাকে সেখানে দেননি তারা।
স্থানীয় বাসিন্দা শিক্ষক এস.এম কলিম উদ্দীন ও শেখ ফয়সাল হোসেন জানান, অনেক কষ্ট করে জীবন পার করছে হোসেন আলী। তার শিকলবন্দী জীবন দেখে প্রতিবেশীসহ সবার খারাপ লাগে। তবে কিছু করার নেই। কারণ তাকে ছেড়ে দিলে দূরে চলে যায়। অনেক দিন কোন খোঁজ থাকে না। তাছাড়া আশপাশের শিশুরাও তাকে দেখে একটু ভয় পায়।
হোসেন আলীর বাবা মো. মালেক সরদার বলেন, ছোটবেলায় অন্য শিশুদের থেকে ভিন্ন আচরণ করত হোসেন আলী। সে কথা বলতে পারত না। বিভিন্ন রকম অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণ করত। একপর্যায়ে তাকে আমরা বিভিন্ন ডাক্তার ও কবিরাজ দেখানোর পরে জানতে পারি সে প্রতিবন্ধী। ছোটবেলায় তাকে ছেড়ে দিয়ে রাখলে সে বিভিন্ন স্থানে চলে যেত। কয়েকদিন নিখোঁজ থাকার পর তাকে বহু কষ্টে খুঁজে পাওয়া যেত। তাই বাধ্য হয়ে তাকে প্রায় ১৮ বছর ধরে শিকলবন্দী করে রেখেছি। আমাদের থেকে দূরে চলে যাওয়া ঠেকাতে এটা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।তিনি আরও বলেন, একটি প্রতিবন্ধী কার্ড ছাড়া তার কিছুই নেই। সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থাকলেও হোসেন আলী তা থেকে বঞ্চিত। অভাবের সংসারে প্রতিবন্ধী ছেলে নিয়ে তারা নিদারুন কষ্টে দিনাতিপাত করে।
হোসেন আলীর মা আছিয়া বেগম বলেন, তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে হোসেন আলী বাক ও মানসিক প্রতিবন্ধী। বাক ও মানসিক প্রতিবন্ধী হলেও তাকে ছাড়া আমরা থাকতে পারি না। তাই বাধ্য হয়ে তার পায়ে শিকল দিয়ে রাখি। সকালে তাকে ঘর থেকে বের করে বাড়ির পেছনে রাস্তার ধারে শিকলবন্দী করে রাখি। সন্ধ্যায় তাকে উঠিয়ে নিজ হাতে গোসল করিয়ে ভাত খাওয়ানো হয়। তারপর ঘরের মধ্যে তালাবন্দী করে রাখি। এটা আমার নিত্যদিনের কাজ। সে যদি মারা যায় তাহলে আমার কাছে থেকে মারা যাক। তবুও তাকে আমি দূরে যেতে দিতে চাই না।
তিনি আরও বলেন, অনেক চিকিৎসক দেখানোর পরও তাকে সুস্থ করা সম্ভব হয়নি। তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে পাঠানোর কথা থাকলেও নির্যাতনের ভয়ে সেখানে পাঠাইনি। শুনেছি পাবনা মানসিক হাসপাতালে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবুল কালাম আজাদ জানান, হোসেন আলীকে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড দেওয়া হয়েছে। তবে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে অন্য কোন সুযোগ সুবিধা সে পায়না। উপজেলা প্রশাসন যদি তার প্রতি সুনজর দেন তাহলে হয়ত হোসেন আলীর পরিবার আরও একটু সুযোগ সুবিধা আওতায় আসতে পারতো। তালা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ রাজীব সরদার জানান, ছেলেটা মানসিক প্রতিবন্ধী। স্থানীয়ভাবে তার ভালো চিকিৎসা সম্ভব নয়। বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করে পাবনা মানসিক হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব। তবে বয়স বেড়ে যাওয়ায় সুস্থ হওয়ার সম্ভবনা খুবই কম।