বেরোবি প্রতিনিধি: কোটা আন্দোলনের প্রথম শহীদ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মৃত্যুতে যখন সারা বিশ্বের মানুষ শোকার্ত ও বাকরুদ্ধ ঠিক সেই মুহূর্তে আবু সাঈতের মৃত্যু নিয়ে শিক্ষকদের মাঝে নতুন করে অপরাজনীতি শুরু হয়েছে।
এক শিক্ষক নেতার মদতে নানাভাবে অপপ্রচার চালিয়ে ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল করতে চেষ্টা করছেন বলেও অভিযোগ ওঠেছে সেই শিক্ষক নেতার বিরুদ্ধে। শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু নিয়ে অপরাজনীতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কোটা আন্দোলনকারীরা। এ নিয়ে অপরাজনীতি না করার আহ্বান জানিয়েছেন কোটা আন্দোলনের সমন্বয়করা।
জানা গেছে, সাবেক উপাাচর্যের আমলের কতিপয় শিক্ষক কর্মকর্তা দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতাসহ নানা অভিযোগে কোনঠাসা হয়ে রয়েছেন। বর্তমান উপাচার্য দায়িত্ব নিয়ে এক বছরেই সেশনজট নিরসনসহ শিক্ষার্থীবান্ধব নানা কর্মকাণ্ডের কারণে শিক্ষার্থীরাও প্রশাসনের প্রতি সন্তুষ্ট। তাই তাদের সাথে নিয়ে আন্দোলন করতে কয়েকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন তারা। ফলে বর্তমান উপাচার্যের বিগত তিন বছরে আন্দোলন করার মতো কোনো ইস্যুই পাচ্ছিল না সাবেক উপাচার্যপন্থী ওই শিক্ষক ও কর্মকর্তারা।
সাম্প্রতিক সময়ে আবু সাঈদ নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তারা নতুন করে সরব হয়ে উঠেছেন। প্রশাসনের বিরুদ্ধে উস্কানি দিতে নানা অপপ্রচারও চালিয়ে যাচ্ছেন।
অনুসন্ধানে জানাগেছে, সাবেক উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে পরিচিত এক শিক্ষক নেতার নিয়োগ জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে তথ্যানুসন্ধান কমিটি। বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনও তালিকাভুক্ত করেছে। বর্তমানে সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্তক্রমে তদন্ত চলছে। দুদকের চিঠির বরাত দিয়ে ইউজিসির চাহিদার প্রেক্ষিতে সাবেক উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ এক কর্মকর্তার সনদ জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই বিষয়েও একটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে।
সাবেক উপাচার্যের ঘণিষ্ঠ আরো কয়েক কর্মকর্তার দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে দাপ্তরিকভাবে তদন্ত চলছে। ফলে তদন্ত কাজ বাধাগ্রস্ত করতে নানা ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। এরই অংশ হিসেবে তারা নিজেদেরকে রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যুকে বেছে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তারা শিক্ষার্থীদের মাঝে নানা অপপ্রচার চালিয়ে প্রশাসনের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
কোটা আন্দোলনের মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে ভিন্নধারায় প্রবাহিত করে কতিপয় শিক্ষক ও কর্মকর্তার নিজেদের সার্থ হাসিলের চেষ্টার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন একাধিক শিক্ষার্থী।
মাস্টার্সের শিক্ষার্থী যুথি রানী নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা আমাদের দাবিতেই থাকতে চাই। কোনো শিক্ষকের খেলার বস্তু হতে আসিনি। অপর এক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদেরকে উত্তেজিত করে নিজেদের সার্থ হাসিলের ফাঁদে আমরা পা দিবো না। আমরা প্রশাসনের বিরুদ্ধে নই। আমরা কোটা সংস্কার আন্দোলনে আছি।
কোটা আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ক বলেন, আমাদের আন্দোলনকে অনেকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা চালাচ্ছেন। আমরা ছোট বাচ্চা নই যে, আমাদেরকে তারা ব্যবহার করবে। মর্মান্তিক এই বিষয়টি নিয়ে কেউ যেনো অপপ্রচার না করার অনুরোধ করেন তারা।
প্রসঙ্গত, কোটা সংস্কারের দাবিতে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে গত ১৬ জুলাই বেরোবিসহ রংপুর নগরীর সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে বিশাল একটি মিছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নং গেটে (যা বর্তমানে ‘শহিদ আবু সাঈদ গেট’ নামে পরিচিত) অবস্থান নেয়।
খবর পেয়ে প্রক্টরিয়াল বডির কয়েকজন সদস্য ঘটনাস্থলে যান। প্রক্টরের অনুরোধে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকও ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তাদের দাবি সকলে মিলে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে পুলিশ-আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
পুলিশ শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছুঁড়তে থাকলে শিক্ষার্থীরা ইটপাটকেল ছুঁড়তে থাকে। এসময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন কোটা আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ।
এদিকে আন্দোলনের সময় ঘটনাস্থলে কয়েক শিক্ষকের উপস্থিতি নিয়ে পরিবেশ ঘোলা করার চেষ্টা করছেন কতিপয় শিক্ষক। সেই সময়ের উপস্থিতির ছবি এডিটিং করে কাটিং করে প্রকাশ করা হচ্ছে। অথচ ঘটনার সংবাদ সংগ্রহ করতে সেখানে ছিলেন রংপুরের স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরাও।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা একটি বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশনের একজন সাংবাদিকের রেকর্ড করা একটি ভিডিও সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে—তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসের সেকশন অফিসার মো. রাফিউল হাসানকে জিজ্ঞেস করছেন—‘আপনি কী পুলিশ? আপনি গুলি মারতে বললেন কেন?’
জবাবে ওই কর্মকর্তা পিছু হটতে হটতে ভীত চেহারায় বলেন, ‘না আমি পুলিশ নই; আমি বলিনি।’ এই নিয়ে ঐ সাংবাদিক ও অফিসারের মধ্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছিলো। এমন সময় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান মন্ডল আসাদ ঐ অফিসারকে সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। পরে ঐ অফিসার সেখান থেকে চলে যায়।
এ ঘটনাটিকে ভিন্নভাবে প্রবাহিত করতে শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক তাবিউর রহমান তার নিজের বিভাগের শিক্ষার্থীদের দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার শুরু করে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন। এমনকি তিনি বিষয়টি নিয়ে অনেক গণমাধ্যমকর্মীর কাছে নিউজ করার জন্য তদবির করেন। বাম নেতাদের দিয়ে বিবৃতি প্রদান করানোর বিষয়েও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে।
এই বিষয়ে এটিএন নিউজের প্রতিবেদক শাহরিয়ার মীম একটি অনলাইনে প্রকাশিত নিউজের নিচে মন্তব্য করেন যে, “ঐ সাংবাদিক আমি। রাসেল শুধু গুলি মার মার করছিলো। এটা আমি শুনে দূর থেকে এগিয়ে এসে বলছিলাম, আপনি কি পুলিশ? এছাড়া কোনো শিক্ষককে গুলি বা মারামারি করার কথা বলতে শুনিনি। নিউজে খানিকটা ভুল তথ্য আছে।”
ঘটনাস্থলে উপস্থিত বেসরকারি টিভি চ্যানেল এনটিভির সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার ময়নুল ইসলাম বলেন, ঘটনার সময় আমরা বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ঘটনাস্থলেই ছিলাম। টিয়ারশেলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান মন্ডল আসাদ আমাকে সুস্থ হতে সহযোগিতা করেন। শিক্ষার্থী, সাংবাদিক সবার সাথেই তাকে অভিভাবকসুলভ আচরণ করতে দেখেছি। তিনি পরিস্থিতি শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান মন্ডল আসাদ বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডরমেটরিতে বসবাস করি এবং একজন শিক্ষক হিসেবে প্রক্টর স্যারের অনুরোধে আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু একর্যায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ঘটনাস্থল টিয়ারশেলে ছেয়ে গেলে, শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় আমি দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করি। কিছুক্ষণ পর শুনি আমাদের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ নিহত হয়েছে।
আপনি হেলমেট পড়ে কেন গিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাকে যখন প্রক্টর ঘটনাস্থলে যেতে বলেন, তখন আমি আমি বাইকে ছিলাম। বাইক নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়েছি। মাথায় আগে থেকেই হেলমেট ছিলো। পরিস্তিতিও খারাপ, ইট-পাটকেল লাগতে পারে। যাতে অন্তত মাথাটা সেভ থাকে, সেজন্য আমি হেলমেট পড়েই ছিলাম।
একজন শিক্ষক অভিযোগ করে বলেন, নিহত আবু সাঈদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগকে পুঁজি করে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুটি কয়েকজন। তারা শিক্ষক রাজনীতি ও প্রশাসনে সুবিধা করতে না পেরে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং প্রশাসনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এমন অপচেষ্টা বেরোবি শিক্ষক সমাজ মেনে নিবে না। তাদের ষড়যন্ত্র সফল হতে দেয়া হবে না।
ঘটনার দিন শিক্ষক তাবিউর রহমান ক্যাম্পাসে অবস্থান করলেও পরিস্থিতি শান্ত করা বা সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে কেন দাড়াননি এ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন এই শিক্ষক।
এদিকে কোটা আন্দোলনের ঘটনায় সারাদেশে কারফিউ জারিসহ সেনা মোতায়েন করায় রংপুরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণাসহ আবাসিক হল বন্ধ করায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কোনো শিক্ষার্থী নেই। ফলে পরিস্তিতি অনেকটা শান্ত রয়েছে। কিন্তু কোটা বিরোধী আন্দোলনকে প্রশাসন বিরোধী আন্দোলনে পরিণত করতে কয়েক শিক্ষক-কর্মকর্তার অপচেষ্টায় বিব্রত শিক্ষকরা। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সাথে সাথেই প্রশাসন বিরোধী আন্দোলন শুরু করতেই মূলত মাঠ প্রস্তুত করছেন তারা।
বর্তমান উপাচার্যের শেষ বছর হওয়ায় তারা আবু সাঈদের মৃত্যুকে উপাচার্য বিরোধী আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে নিচ্ছেন তারা।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর ড. বিজন মোহন চাকী বলেন, এখন জাতীয় সংকট। এ সংকটময় মূহুর্তে যারা সুবিধা নিতে চায় তাদের ব্যপারে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীর মৃত্যু নিয়ে অপরাজনীতি করা উচিৎ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন সংকটে যারা সুবিধা নিতে চায়, তারা বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের ভালো চায় না। এটা ন্যাক্কারজনক।