শুক্রবার, ১৩ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ,২৭শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

এর সর্বশেষ সংবাদ

ইরানের অভ্যন্তরে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছিল মোসাদ

যায়যায়কাল ডেস্ক : ইসরায়েল গত শুক্রবার ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা এবং শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের ওপর নজিরবিহীন হামলা চালানোর আগে তাদের গুপ্তচররা কীভাবে শত্রুপক্ষের মাটিতে শক্ত অবস্থান নিয়ে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছিল, তা উঠে এসেছে সিএনএন এর এক প্রতিবেদনে।

ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বরাতে মার্কিন সংবাদমাধ্যমটি লিখেছে, হামলার আগে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ইরানে অস্ত্র পাচার করে এবং সেই অস্ত্র ব্যবহার করে ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ভেতর থেকেই আঘাত হানার পরিকল্পনা সাজায়।

মোসাদের এজেন্টরা ইরানের ভেতরেই বিস্ফোরকবাহী ড্রোন ওড়ানোর একটি ঘাঁটি স্থাপন করে ফেলেন। সেখান থেকে পরে তেহরানের কাছে ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ স্থাপনাগুলোতে হামলা চালানো হয়। নিখুঁত নিশানায় হামলা চালানোর মত অস্ত্রও পাচার করা হয় ইরানে, যেগুলো ব্যবহার করে ইরানের ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়।

আর সে কারণেই ইসরায়েলি বিমানবাহিনী ২০০টির বেশি জঙ্গিবিমান নিয়ে শুক্রবার ভোরে ১০০টির বেশি হামলা চালাতে সক্ষম হয়।

ইসরায়েলের দাবি, এই পরিকল্পনার মাধ্যমে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অকার্যকর করে দেওয়া সম্ভব হয়। তার ফলে প্রথম দফা হামলা চালিয়ে তাদের সব বিমান ২০০০ কিলোমিটার পর পেরিয়ে নিরাপদে ইসরায়েলে ফিরে যায়।

ইরানে বসে মোসাদ এজেন্টরা যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছেন, তা ব্যবহার করেই ইসরায়েলি বিমানবাহিনী ইরানের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা এবং বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য করে হামলা চালাতে সক্ষম হয়।

মোসাদ তাদের কিছু অভিযানের ভিডিও প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখা যায় ড্রোন হামলা চালিয়ে কীভাবে অপ্রস্তুত ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপক অকেজো করে দেওয়া হচ্ছে। মোসাদের এরকম ভিডিও প্রকাশের ঘটনা খুবই বিরল।

সিএনএন লিখেছে, ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো, বিশেষ করে মোসাদ কীভাবে ইরানের সবচেয়ে গোপনীয় জায়গায় ঢুকে পড়েছে, সর্বশেষ অভিযান সেটাই স্পষ্ট করেছে।

এ অভিযানের ফলাফল দেখে মনে হচ্ছে, ইরানের ভেতরে মোসাদ একপ্রকার অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। তারা ইরানের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তা এবং সবচেয়ে স্পর্শকাতর স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করেও হামলা চালাতে পারছে।

ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো ও ‘দ্য ইরানিস্ট’ নিউজলেটারের কিউরেটর হলি ড্যাগ্রেস বলেন, “মোসাদ বহু বছর ধরে ইরানকে তাদের খেলার মাঠ বানিয়ে রেখেছে।

“শীর্ষ পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের হত্যা থেকে শুরু করে পরমাণু স্থাপনায় ধ্বংসাত্মক হামলার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল বারবার প্রমাণ করেছে, এই ছায়াযুদ্ধে শুরু থেকেই তারা এগিয়ে আছে, যা ২০২৪ সালের এপ্রিলে শুরু হওয়া পাল্টা-পাল্টি হামলা শুরুর পর আরো স্পষ্ট হয়েছে।”

ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর একটি সূত্রের বরাত দিয়ে সিএনএন লিখেছে, সর্বশেষ এই অভিযানে তেহরানসহ ইরানের গভীরে কমান্ডো বাহিনী মোতায়েন করা হয়, যারা দেশটির গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে কাজ করে গেছে।

তিনি জানান, ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর যখন হামলা শুরু করে, মোসাদ বাহিনী তখন ইরানে বসে দেশটির আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং মিসাইল লঞ্চারগুলো লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে।

ইসরায়েলের আরেকজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানান, মোসাদের এই অভিযান বহু বছরের প্রস্তুতির ফল, যার মধ্যে গোপনে তথ্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে শত্রুপক্ষের ভেতরে ঢুকে নিজেদের বাহিনী মোতায়েন করার মত বিষয় ছিল।

মোসাদের কিছু কমান্ডো তেহরান শহরের ভেতরেই কাজ করছে বলে ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

শুক্রবারের হামলার বহু আগেই মোসাদ সেখানে ড্রোন ঘাঁটি তৈরি করেছিল। পাশাপাশি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কাছেই ‘নিখুঁত নিশানায় আক্রমণ শানাতে সক্ষম’ অস্ত্র স্থাপন করেছিল মোসাদ বাহিনী, যেগুলো ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর আক্রমণের সময় একযোগে সক্রিয় করা হয়।

একটি পৃথক অভিযানে গাড়িতে বসানো উন্নত অস্ত্র ব্যবহার করে ইরানের অন্যান্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় হামলা চালানো হয়। ইরানের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা ও বিজ্ঞানীদের হত্যার বিষয়টিও এ অভিযানের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

সিএনএন লিখেছে, মোসাদ ইরানে কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, ইসরায়েল অতীতেও প্রায় প্রকাশ্যেই তা দেখিয়েছে।

২০১০ এর দশকের শুরু থেকেই ইরান অভিযোগ করে আসছে, তাদের পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যার জন্য গোপন অভিযান চালিয়ে আসছে ইসরায়েল।

ইসরায়েলের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে ইয়ালনও ২০১৫ সালে এক বক্তব্যে সেই প্রসঙ্গ তোলেন। তিনি বলেছিলেন, “ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীদের আয়ু নিয়ে ইসরায়েলকে দায়ী করা যায় না।”

২০০৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ইসরায়েল গোপনে পাঁচটি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অধিকাংশ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তেহরানে, আর সেসব ক্ষেত্রে রিমোট-কন্ট্রোলড বোমা বা মেশিনগান ব্যবহার করা হয়েছে। ইরানের যে পরমাণু বিজ্ঞানীদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে, তাদের মধ্যে ফেরেইদুন আব্বাসি ছাড়া আর কেউ বাঁচতে পারেননি।

আব্বাসি গত মাসে ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, প্রোডাকশন সাইটগুলোতে হামলা হলে তাতে পারমাণবিক বোমা তৈরির কাজ পেছাবে না।

“কারণ আমাদের সক্ষমতা সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। তারা যদি উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে হামলা চালায়, তাতেও তেমন কিছু হবে না, কারণ আমাদের পারমাণবিক উপকরণ উপরে রাখা হয় না, যাতে সহজে টার্গেট করা যায়।”

শুক্রবার ভোরে তেহরানে চালানো ইসরায়েলের হামলায় সেই আব্বাসিও নিহত হন।

সিএনএন লিখেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মোসাদের কর্মকাণ্ড আরও প্রকাশ্য হয়ে ওঠে।

২০১৮ সালের শুরুতে ইসরায়েল তেহরান থেকে ইরানের পারমাণবিক আর্কাইভ চুরি করে, এবং পরে জেরুজালেম থেকে একটি লাইভ সম্প্রচারে সেই গোয়েন্দা সাফল্য তুলে ধরে। ইংরেজিতে ভাষণ দিয়ে নেতানিয়াহু দাবি করেন, তারা ৫৫ হাজার পৃষ্ঠার নথিপত্র এবং ৫৫ হাজার ফাইল-ভর্তি ডিস্ক উদ্ধার করেছেন।

ইরান নেতানিয়াহুর বক্তব্যকে ‘শিশুসুলভ’ ও ‘হাস্যকর’ বলে উড়িয়ে দিলেও এই আর্কাইভ চুরির মধ্য দিয়ে তেহরানে মোসাদের কাজের সক্ষমতা নিয়ে ইসরায়েলের আস্থা মজবুত করে।

ইসরায়েলের ওই পরিকল্পনা সফল করতে দীর্ঘ প্রস্তুতি, আর্কাইভের অবস্থান ও নিরাপত্তা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন ছিল। আর সেটাই ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের প্রশাসনকে ইরানের সঙ্গে করা পরমাণু চুক্তি—জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন থেকে সরে আসতে প্রভাবিত করেছিল।

তবে ইসরায়েল সেখানেই থেমে থাকেনি।

২০২০ সালের নভেম্বরে ইরানের প্রধান পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহকে হত্যা করে ইসরায়েল। তিনি তখন স্ত্রীকে নিয়ে বুলেটপ্রুফ গাড়িতে ভ্রমণ করছিলেন। তার গাড়িটি তিনটি গাড়ির নিরাপত্তা কনভয়ের অংশ ছিল, তখনই হামলা চালানো হয়।

ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী, দূরনিয়ন্ত্রিত মেশিনগান থেকে গুলি ছোড়া হয় ফাখরিজাদেহর দিকে, যিনি দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের নিশানায় ছিলেন।

ইসরায়েল ওই হত্যাকাণ্ডের দায় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি। তবে ওই অভিযান যে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে পরিচালিত হয়েছিল এবং ফাখরিজাদেহর দৈনন্দিন রুটিন সম্পর্কে যে হত্যাকারীদের খুব স্পষ্ট ধারণা ছিল, হামলার ধরনেই তা স্পষ্ট হয়।

বার বার মোসাদের এসব হামলা ও হত্যার পরও ইরান তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সেভাবে উন্নত করতে পারেনি।

মোসাদের সাবেক উপপরিচালক রাম বেন বারাক বলেন, ইরানের শাসনব্যবস্থার প্রতি দেশটির জনগণের প্রবল ক্ষোভ গুপ্তচর অনুপ্রবেশ সহজ করে দেয়। পাশাপাশি ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও পেশাদারত্ব ধারাবাহিক সাফল্যের পেছনে বড় ভূমিকা রাখে।

গাজা যুদ্ধ শুরুর পর ইসরায়েল হামাসের রাজনৈতিক নেতা ইসমাইল হানিয়াকে তেহরানের মধ্যেই হত্যা করে।

বিষয়টি নিয়ে অবগত একটি সূত্রের বরাত দিয়ে সিএনএন লিখেছে, হানিয়া যে গেস্ট হাউজে থাকতেন, সেখানে গোপনে একটি বিস্ফোরক স্থাপন করে ইসরায়েল। বোমাটি দুই মাস ধরে সেখানে ছিল এবং হানিয়া ঘরে প্রবেশ করার পর রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে তাতে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Tumblr
Telegram

বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *