শুক্রবার, ১৩ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ,২৭শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

এর সর্বশেষ সংবাদ

ইরানের শাসনব্যবস্থা বদলানোই লক্ষ্য ইসরায়েলের

যায়যায়কাল ডেস্ক: মুখে ইসরায়েল যেমনটা বলছে যে তাদের শুক্রবারের হামলার লক্ষ্য ছিল তেল আবিবের ‘অস্তিত্বের জন্য হুমকি’ ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতাকে ছেঁটে ফেলা, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সম্ভবত আরও বড় লক্ষ্য আছে—তেহরানের শাসনব্যবস্থা বদলে ফেলা।

তিনি হয়তো ভাবছেন, ইরানে ইসরায়েলের নজিরবিহীন হামলা এমন এক ‘চেইন রিঅ্যাকশনের’ শুরু করে দেবে, যার চূড়ান্ত পরিণতি দাঁড়াবে তুমুল অস্থিরতা-অশান্তি, যা ইসলামী প্রজাতন্ত্রটির পতন ঘটাবে।

শুক্রবার সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে নিজের আশাবাদের কথা প্রকাশ্যে বলেও ফেলেছেন তিনি।

“সময় এসেছে ইরানের জনগণের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার, নিজেদের পতাকা ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের চারপাশে একত্রিত হয়ে নির্যাতনকারী ও অশুভ শাসন থেকে মুক্তির জন্য রুখে দাঁড়ানোর,” বিবৃতিতে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এমনটাই বলেছেন বলে জানিয়েছে বিবিসি।

ব্রিটিশ এ সংবাদমাধ্যমটি বলছে, ইরানি জনগণের অনেকেই তাদের অর্থনীতির অবস্থা, সীমিত বাকস্বাধীনতা, নারী অধিকার ও সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে অসন্তুষ্ট।

তার মধ্যে ইসরায়েলের এ হামলা ইরানের নেতৃত্বের জন্য সত্যিকারের হুমকি হয়েই এসেছে।

হামলায় ইরানের বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর (আইআরজিসি) কমান্ডার, সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানসহ উচ্চপদস্থ অনেক আইআরজিসি কর্মকর্তা নিহত হয়েছে। ইসরায়েলের হামলা এখনও শেষ হয়নি, তাতে উচ্চপদস্থ আরও অনেকের প্রাণ যাওয়ার শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

শুক্রবার বিকালেই ইরান ইসরায়েলি হামলার পাল্টা জবাব দেওয়া শুরু করে। বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী জানায়, তারা ইসরায়েলের সামরিক কেন্দ্র, বিমানঘাঁটিসহ কয়েক ডজন লক্ষ্যে হামলা চালিয়েছে।

পরিস্থিতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে; এরপর ইরানের পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর নেতানিয়াহু বলেন, “আরও কিছু আসছে।”

তার মানে, ইরানের আরও অনেক নেতাকে তেল আবিব নিশানা বানাতে পারে।

ইসরায়েলের হিসাব হয়তো বলছে, এই হামলা ও হত্যাকাণ্ডগুলো ইরানের ইসলামী শাসনব্যবস্থাকে টলিয়ে দেবে এবং তাদের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের পথ করে দেবে।

অন্তত, এমনটাই আশা নেতানিয়াহুর।

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা একে বড়সড় জুয়াই মনে করছেন।

তেল আবিবের হামলার পর ওই ‘চেইন রিঅ্যাকশন’ শুরু হওয়ার কোনো লক্ষণ এখনও দেখা যাচ্ছে না, আর যদি হয়ও তাহলেও তা শেষ পর্যন্ত কোন দিকে নিয়ে যাবে তাও স্পষ্ট নয়।

ইরানে তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী যারা সশস্ত্র বাহিনী ও অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন; আর এই দুই খাতের বেশিরভাগই রয়েছে আইআরজিসির কট্টরপন্থি অংশ এবং অন্যান্য কিছু অনির্বাচিত কর্তৃপক্ষের হাতে।

তাদের তো আর অভ্যুত্থান করার প্রয়োজন পড়ছে না, কারণ আদতে তারা-ই ক্ষমতায়! এবং এরপরও যদি তারা সামনেই আসতে চান, সেক্ষেত্রে তেহরান আরও বেশি যুদ্ধংদেহী অবস্থানে চলে যেতে পারে বলে অনেকের আশঙ্কা। এমনটা ইসরায়েলের চাওয়ার কথা না।

আরেকটা বিকল্প হচ্ছে, যেটা নেতানিয়াহুও চাইছেন—ইরানজুড়ে অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা, এবং এর সূত্র ধরে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন।

প্রায় ৯ কোটি জনসংখ্যার একটি দেশে এমন যে কোনো কিছু হলে, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তার মারাত্মক প্রভাব পড়বে।

ইসরায়েল হয়তো চাইছে, বিক্ষোভ-গণঅভ্যুত্থানের পর তেহরানের শাসনব্যবস্থায় মিত্র কাউকে বসাতে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কে হবে সেই মিত্র, যে এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবে?

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানের বিরোধী শক্তিগুলো ভীষণভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ায় কারা বিকল্প হতে পারে, সে সম্বন্ধে পরিষ্কার কিছু বোঝার উপায় নেই।

২০২২ সালে ইরানের বেশিরভাগ অংশে ‘উইমেন লাইফ ফ্রিডম’ নামে পরিচিত আন্দোলনে বিক্ষোভ-অস্থিরতার পর কিছু বিরোধী শক্তি ইসলামিক প্রজাতন্ত্রবিরোধী গোষ্ঠী ও কর্মীদের বিরুদ্ধে একটি বিস্তৃত জোট গঠনের চেষ্টা করেছিল।

কিন্তু কে নেতা হবে, এবং পরবর্তী শাসনব্যবস্থা কেমন হতে পারে তা নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতায় ওই প্রচেষ্টা খুব বেশিদূর এগোয়নি।

ওই গোষ্ঠী বা ব্যক্তির কেউ কেউ হয়তো ইসরায়েলের নেতাদের পছন্দের তালিকায় থাকতে পারেন।

যেমন ধরা যাক, ইরানের সাবেক ক্রাউন প্রিন্স রেজা পাহলভির কথা। তিনি ১৯৭৯ সালে দেশে ইসলামী বিপ্লবে উৎখাত হওয়া সাবেক শাহের ছেলে।

তিনি নির্বাসনে আছেন এবং তার পক্ষে বিদেশি ক্রীড়নকদের সমর্থন যোগাড়ে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাকে ইসরায়েল ভ্রমণ করতেও দেখা গেছে।

কিছু ইরানির মধ্যে তার খানিকটা জনপ্রিয়তা আছে বলে মনে করা হলেও কিন্তু এরা দ্রুত বড় শক্তি হয়ে উঠে এখনকার শাসনব্যবস্থা বদলে ফেলতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।

এর বাইরে আছে, মুজাহিদিন-ই খালক (এমইকে)। নির্বাসিত এ গোষ্ঠীটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্রকে উচ্ছেদের পক্ষে, কিন্তু একইসঙ্গে এরা পুরনো রাজতন্ত্রেও ফিরতে চায় না। বাম-ঘরানার এই মুসলিম গোষ্ঠীটি শাহ-শাসনের তুমুল বিরোধী ছিল।

বিপ্লবের পর এমইকে ইরাকে চলে যায় এবং ১৯৮০-র শুরুর দিকে সাদ্দাম হোসেন ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলে তারা তার সঙ্গে যোগ দেয়। এ কারণে অনেকে ইরানির মধ্যেই এরা বেশ অজনপ্রিয়।

গোষ্ঠীটি এখনও সক্রিয় এবং যুক্তরাষ্ট্রে এদের অনেক বন্ধুও আছে, যাদের অনেকে আবার ডনাল্ড ট্রাম্প শিবিরেরও ঘনিষ্ঠ।

তবে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের তুলনায় এখনকার প্রশাসনে এমইকে-র প্রভাব অনেক কম। আগেরবার গোষ্ঠীটির অনেক অনুষ্ঠানে মাইক পম্পেও, জন বোল্টন ও রুডি জুলিয়ানিকে উপস্থিত হতে এবং এমইকে-র সমর্থনে বক্তব্য দিতেও দেখা গেছে।

এর বাইরেও ইরানের অনেক রাজনৈতিক শক্তি আছে, যারা এখনকার শাসকদের উৎখাত করতে চান। তাদের কেউ কেউ চান ইরানকে সেক্যুলার গণতান্ত্রিক দেশ বানাতে, কেউ চান ইরানে চলুক সাংবিধানিক রাজতন্ত্র, কেউ আবার অন্য কিছু চান।

এসব ভেদাভেদ এতই তীব্র যে এদেরকে এক ছাতার নিচে আনা মোটেও সহজ নয়।

যে কারণে শুক্রবারের ইসরায়েলি হামলার পর ইরানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন দাঁড়ায় তা এখনই কল্পনা করা যাচ্ছে না।

গত বছর তেল আবিব ও তেহরানের মধ্যে হওয়া দুই দফার পাল্টাপাল্টি হামলার কথা বিবেচনায় নিলে, এমন কোনো পরিস্থিতিকে ইরানিরা যে শাসনব্যবস্থা বদলানোর সুযোগ হিসেবে দেখতে পারে তা মনে হচ্ছে না। যদিও শুক্রবারের হামলার তীব্রতা ও তাতে ধ্বংসযজ্ঞের পরিমাণের সঙ্গে ওই দুইবারের তুলনা হবে না।

ইরানের লক্ষ্য যা হতে পারে

পাল্টা হামলায় তেহরান ইসরায়েলের অনেক জায়গা ও স্থাপনাকে নিশানা বানালেও, তাদের হাতে আসলে খুব বেশি বিকল্প নেই।

অনেকের কাছে মনে হতে পারে, ইরানের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ হচ্ছে তাদের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া এবং উত্তেজনা এখন যে পর্যায়ে আছে, তা কমিয়ে আনা।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পও এমনটা চাইছেন। কিন্তু ওই আলোচনায় ফিরে যাওয়ার মানেই হচ্ছে, ইরানি শাসকরা নিজেদের পরাজয় মেনে নিচ্ছেন।

আরেকটা বিকল্প হচ্ছে, ইসরায়েলের হামলার জবাবে পাল্টা হামলা চালানো।

দৃশ্যত এটাই সবচেয়ে ‘আকাঙ্ক্ষিত’ বিকল্প। ইরানের নেতারাও তাদের সমর্থকদের কাছে ‘পাল্টা জবাবের’ অঙ্গীকার করেছেন। কিন্তু ভেবে দেখা দরকার, ওই পাল্টা জবাবের পরিণতি হচ্ছে ইসরায়েলের আরও হামলা।

তেহরান এর আগে মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন ঘাঁটি, দূতাবাস এবং মার্কিন স্বার্থে হামলা চালানোর হুমকিও দিয়েছিল। কিন্তু এমন কিছু করলে ওয়াশিংটনও এ যুদ্ধে সামনে থেকে জড়িয়ে পড়তে পারে, যেটা এ মুহূর্তে ইরানে চাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে কম।

এ এক এমনই দাবা খেলা, যাতে ইরান বা ইসরায়েল যে বিকল্পই বেছে নিক না কেন, তার বাস্তবায়ন যেমন সহজ হবে না তেমনি তার পরিণতি কী হতে পারে, তা অনুমান করাও বেশ কষ্টসাধ্য।

“বাতাসে এখনও ধুলা উড়ছে, সেটা স্থির না হওয়া পর্যন্ত আমরা জানবো না কী কী পরিবর্তন ঘটে গেছে,” বলেছেন বিবিসি পারসিয়ানের সম্পাদক আমির আজিমি।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Tumblr
Telegram

বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *